মনসামঙ্গল কাব্যের সেকাল-একাল।
সেকাল-( প্রথম পরিচ্ছদ ) ।
সপ্তাহান্তের ছুটিতে টাইম মেশিনে চেপে চলুন সেকালের মঙ্গলকাব্যের চাঁদ বণিকের খোঁজে, বেহুলা লখিন্দরের অমর প্রেমের সন্ধানে , একালের কসবা চম্পাইনগর, পানাগড় , পূর্ব বর্ধমানে। কিন্তু সেজন্য মনসামঙ্গল কাব্য নিয়ে কিছু জানা থাকলে রসাস্বাদন করতে মনে হয় সুবিধা হবে। তাই ছোট করে মনসামঙ্গল নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
![]() |
মনসা মাতার পূজা । |
মনসামঙ্গলের কাহিনী সর্বজনবিদিত। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সম্ভবত প্রাচীনতম মঙ্গলকাব্য এটি। অসংখ্য রচনাকার যুগে যুগে বিভিন্ন আঙ্গিকে, স্থানীয় ভৌগোলিক এবং লৌকিক কাহিনী এবং অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে মনসামঙ্গল রচনা করেছেন।প্রথম রচনাকার কানাহরি দত্ত থেকে শুরু করে পূর্ববঙ্গের বিজয় গুপ্ত(রচনাকাল ১৪৯৪), বিজয় গুপ্তের সমসাময়িক নারায়ণ দেব কিংবা তার ঠিক পরেই রাঢ় বঙ্গের বিপ্রদাস পিপলাই(রচনা ১৪৯৫) যাঁর 'মনসা বিজয়' সেযুগে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি যে কানাহরি দত্ত তার প্রমান পাই বিজয় গুপ্তর "পদ্মাপুরান" গ্রন্থে।
"সর্বলোকে গীত গাহে না জানে মাহাত্ম্য।
প্রথমে রচিল গীত কানাহরি দত্ত।।"
এরপরে জনৈক কেতকাদাস(অর্থাৎ কেতকা বা মা মনসার দাস) ক্ষেমানন্দের রচিত মনসামঙ্গল ( ১৭২৯) ও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। এমন কি আধুনিক যুগেও জরুরী অবস্থার সময় বিশিষ্ট নাট্যকার শম্ভু মিত্র মনসামঙ্গল অবলম্বনে রচনা করেন এক অসাধারণ নাটক ' চাঁদ বণিকের পালা'। এতোগুলো মনসামঙ্গল থেকে বেছে নিচ্ছি কবি বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরান গ্রন্থটি। সেখানে শুরুতেই লেখা আছে দেখছি-
নেতা বলে বিষহরি হেথা রহিয়া কিবা করি
মর্তভূমে চলো যাই।
মর্ত্য ভুবনে যাইয়া ছাগ মহিষ বলি খাইয়া
সেবকেরে বর দিতে চাই।।
এখানে বলার কথা যে নেতা ও মনসা দুজনেই শিবের কন্যা।
![]() |
মনসার মূর্তি । |
'আইলে মনসা দেবী না করি বিচার।
ঊনকোটি নাগ লইয়া দিলা পাটয়ার।।
রত্নময় সিংহাসনে বসিলা বিষহরি।
বাম পাশে বসে নেতা রজক কুমারী।।
এর পরেই কি লেখা আছে পড়ুন-
ক্ষীর নদী হইতে উঠে গড়লের ফনা
মুখ হইতে পড়ে বিষ যেন অগ্নিকনা।।
এটুকু পড়েই বোঝা যাচ্ছে যে মনসাকে ঠিক আর্য দেব-দেবীর ধাঁচে ফেলা যাবে না।তিনি হচ্ছেন এক অসাধারণ অনার্য লৌকিক দেবী যিনি আমাদের মতন সাধারণ মর্তবাসীদের সাবধান করছেন এই বলে-
অহঙ্কারে মোর গীত করে উপহাস।
মোর কোপে হবে তার সবংশে বিনাশ।।
নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার করে বলুন তো, এই কথাগুলো কি ঠিক দেবী সুলভ অভয়বানি বলে মনে হচ্ছে ?
পুরান আশ্রিত মনসা দেবী কশ্যপ ঋষির কন্যা, কিন্তু মঙ্গলকাব্যগুলিতে তাঁকে শিবের কন্যা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। মনসা সাপের দেবী কিন্তু পৌরাণিক চরিত্র কিনা সন্দেহ আছে, তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক দেবী রূপে প্রতিষ্টা করার জন্যই পুরানের অবতারণা করা হয়েছে।
পদ্মপুরান, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান এবং দেবী ভাগবতে মনসার উল্লেখ আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে মনসার উৎপত্তি বলা হয়েছে কশ্যপ মুনির মন থেকে। " কন্যা সা চ ভগবতী কশ্যপস্য চ মানসী।তেনেয়ং মনসা দেবী মনসা যা চ দীব্যতি।।"
আসলে মনসার জন্ম বৃত্তান্ত বেশ অদ্ভুত। শিবের ঔরসে মনসার জন্ম, কিন্তু কোন জননীর গর্ভে তিনি জন্মাননি। মা না থাকায় স্বভাবত তিনি হয়ে উঠেছেন জেদী এবং উদ্ধত।অনেক আবদার করে পিতাকে সম্মত করান বিমাতা পার্বতীর কাছে যাবার জন্য। কিন্তু ভুলবশত পার্বতী মনসাকে তাঁর সতীন মনে করে কুশ দিয়ে তাঁর এক চোখ কানা করে দেন।মনসা তৎক্ষণাৎ পার্বতীকে দংশন করে মেরেই ফেলেন।
"চন্ডীর প্রহার আর সহিতে না পারি।
দেব মূর্তি এড়িয়া পদ্মা নাগ মূর্তি ধরি।"
এর পর কি হোল-
"অতি কোপে পদ্মাবতী করে ধড়ফড়।
চন্ডীর হৃদয়ে দিল বজ্র কামড়।।"
পরে পিতার অনুরোধে বিষ হরণ করে আবার জীবিত করে তোলেন।
এমন কি বিষ পান করে নীলকণ্ঠ শিব যখন অচৈতন্য প্রায়, তখন শিবের এই হতভাগ্য কন্যাই তাঁকে বাঁচিয়ে তোলেন।
"ধ্যান করিয়া বসে দেবী বিষহরী।
পদ্মা বলে বাপ তুমি দেব-অধিকারী।।
কর্ণে মন্ত্র পড়িয়া দেবী বলে উঠ উঠ।
মুখ বাহিয়া বিষ পড়ে ফুট ফুট।।
বুকে হাত দিয়া পদ্মা জপে মহাজ্ঞান।
গা মোড়া দিয়া শিব উঠিল বিদ্যমান।।"
মনসার নাম গান বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে সাধারণত পালাগান এবং কখনও কখনও যাত্রাপালার মাধ্যমে রাতের বেলা পরিবেশিত হতো।একে তো নদীমাতৃক বাংলাদেশে সাপখোপের উপদ্রব এমনিতেই বেশি ছিল, তারমধ্যে রাত্রি বেলায় হ্যারিকেনের আলোয় পালাগানের মধ্যে দিয়ে সবাই শুনছে চাঁদ সওদাগরের একে একে ছয় পুত্র, বন্ধু শঙ্কর, এমনকি অনিরুদ্ধ রুপী ছোট পুত্র লখিন্দরও বাসরঘরে সাপের কামড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে- কি ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসা ও মৃত্যুর মহামিছিলের কাহিনী।আর সত্যি সত্যিই তো তখন সাপের কামড়ের কোন চিকিৎসা নেই, ওঝার ঝাঁড় ফুঁক ছাড়া।তাই মৃত্যু অবধারিতই ছিল- সে বিষেই হোক বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েই হোক।কাজেই গ্রামগঞ্জের এই সহজ সরল লোকগুলি ভয়েই হোক বা ভক্তিতে, মনসা পালায় বিগলিত হয়ে যেতই। কোথাও সেই পালার নাম ছিল বিষহরির গান, কোথাও রয়ানী গান, আবার কোথাও মনসার টপযাত্রা।
মনসামঙ্গল কাব্য সোজাসুজি দুটি পর্বে বিভক্ত। একটিকে বলা যেতে পারে দেব-কথা।এখানে মুখ্য চরিত্র হচ্ছেন মনসা দেবী স্বয়ং। ছলে, বলে, কৌশলে তিনি ব্যস্ত তাঁর দেবত্ব জাহির করতে।অন্য পর্বটিকে বলা যেতে পারে মনুষ্য কথা।এই মনুষ্য কথা আবর্তিত হচ্ছে তিনটি অসাধারণ চরিত্র নিয়ে- চাঁদ বণিক, বেহুলা ও লখিন্দর কে ঘিরে। এবং তিনটি মানব চরিত্রই তাঁদের মানবিক চরিত্রের গুনে অতিশয় সমুজ্জ্বল।
এবার আসি চাঁদ বণিকের কথায়। চাঁদ কোন ভয়ঙ্কর মানুষ নন।তিনি স্ত্রী পুত্রদের নিয়ে ঘোরতর সংসারী। আবার তিনি দেবাদিদেব মহাদেবের পরম ভক্ত এবং কোন অবস্থায়ই ধর্ম চ্যুত্য হতে রাজি নন।শত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও হার-না-মানা তাঁর স্বভাব।তিনি কারো কোন ক্ষতি করেন নি , তবুও তাঁর ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অন্যের হাতে, অন্যের খামখেয়ালিতে এবং দুঃখের বিষয় সেই নিয়ন্ত্রক একজন দেবী যিনি মর্তলোকে পূজা পাবার জন্য চাঁদের বন্ধু শঙ্কুর গাড়রীকে(গড়ুর সাপের শত্রু, অর্থাৎ বিষ চিকিৎসক)বধ করেন। চাঁদকে নির্বংশ করেন, তাঁর বাণিজ্য তরী চৌদ্দডিঙ্গা মধুকর ডুবিয়ে দিয়ে নি:স্ব করেন।
এখানেই না থেমে-"নাগকন্যা একজাতি, সঙ্গে নাগ উনকোটি, নন্দনবাড়ী করিল ছারখার।" এমন কি- ধরিত্রী মাতাকেও আঘাত করতে ছাড়লেন না।
"যত যত বৃক্ষ ছিল, এক গোটা না থুইল,
প্রহরী সব করিল সংহার।"
তবুও চাঁদ না দমলে শেষমেশ স্বর্গের ঊষা ও অনিরুদ্ধ কে পাঠালেন মর্ত্যলোকে, চাঁদকে বশ করার জন্য। কিন্তু এখান থেকেই প্রতিহিংসার গল্প ঘুরে গেল।তৈরী হলো বাঙালির কালজয়ী ভালোবাসার - বেহুলা-লখিন্দরের গল্প, যার তুল্যমূল্য গল্প বিশ্ব সাহিত্যেও বিরল। "কালকেউটের ফনায় নাচছে লখিন্দরের স্মৃতি/ বেহুলা কখনো বিধবা হয়না, এইবাংলার রীতি।"
![]() |
কালকেউটের ফনায় নাচছে লখিন্দরের স্মৃতি, বেহুলা কখনো বিধবা হয়না, এইবাংলার রীতি। |
এখন কথা হচ্ছে যে চাঁদ সওদাগর একটি লৌকিক চরিত্র তবুও চম্পাইনগর বা চাঁদ বণিকের পূজিত শিবমন্দির নিয়ে অনেক আলোচনা ও বিতর্ক আছে।কারো মতে এটি পূর্ব বর্ধমানের মানকরের কাছে কসবা-চম্পাইনগর গ্রামে, আবার অনেকে বলেন এর অবস্থান বাংলাদেশের বগুড়ার কাছে গোকুলমেধ নামক স্থানে। এরকম আরো অনেক দাবিদার আছেন। তাই চলুন চম্পাইনগরের ভৌগোলিক অবস্থান বুঝবার চেষ্টা করি। ঋদ্ধি পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় শ্রীঅনির্বান ভট্টাচার্য এই নিয়ে বিশদ লিখেছেন। তাঁর মতে- অঙ্গদেশ বলতে বোঝাত ' ভাগলপুর, সাঁওতাল পরগনা, ধানবাদ, মালদহ, বীরভূম এবং বর্ধমানের এক বিস্তীর্ণ এলাকা।' অর্থাৎ ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখতে পাচ্ছি, মঙ্গলকাব্যের রচনাকালের সমসাময়িক সময় ১৪৯৩ সালে বাংলার মসনদে আসীন হন সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এবং তিনি বিহারের বিস্তীর্ণ অংশ জয় করে বাংলার সঙ্গে জুড়ে দেন।
সেই সময় গঙ্গা বা ভাগীরথীর তিনটি ধারার মধ্যে প্রধান(আদি গঙ্গা) ধারাটি বিস্তৃত ছিল ত্রিবেণী অবধি , এবং ভাগীরথীর আরো দুটি ধারা বা শাখানদী ছিল যমুনা ও সরস্বতী। এই তিনটি ধারার সঙ্গমেই অবস্থিত ছিল সেকালের বিখ্যাত বন্দর ও বাণিজ্য নগরী সপ্তগ্রাম। আদি গঙ্গার মধ্য দিয়েই বাণিজ্য তরী নিয়ে বনিকেরা বহির্বিশ্বে যাতায়াত করতেন যার মধ্যে চাঁদ সওদাগরের চৌদ্দ ডিঙ্গা ( পদ্ম পুরাণের চৌদ্দডিঙ্গা- চন্দ্ররেখা, সিংহমুখ,গরুড় মহারথী, শঙ্কুচর, সুমন্ত বহাল, সমুদ্র উথাল, গৌরাঙ্গ, মগর, ধুতুরার ফুল, মঙ্গলা, চন্দ্রপাট, সিন্দুর কটুয়া, হাসমড়া এবং মধুকর) হয়ত ছিল।মধ্য যুগে ব্যাবসা বাণিজ্য চলত বিনিময় প্রথায় " কলাই দেখিয়া রাজার আনন্দ বিশাল।ইহার বদলে দিল মুক্ত প্রবাল" । আবার কড়ি প্রথাও চালু ছিল। যেমন বিজয় গুপ্তের লেখায় পাচ্ছি- " একপন করি দিয়া ক্ষৌরশুদ্ধি হবে। আর একপন কড়ি দিয়া চিড়া কলা খাব।।
আর একপন করি দিয়া নটি বাড়ি যাব।
আর একপন কড়ি নিয়া সোনেকারে দিব।। "
বিপ্রদাস পিপলাই বিরচিত মনসামঙ্গলে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য তরী কোন পথে যাতায়াত করত সেই বর্ণনা দেওয়া আছে। চাঁদের ডিঙ্গা সপ্তগ্রাম বন্দর/ত্রিবেণী হয়ে সমুদ্রপথে গমন করত। শ্রদ্ধেয় নিহাররঞ্জন রায়ের বাংলার ইতিহাস, আদি পর্ব( প্রথম প্রকাশন ১৯৭২, পুনর্মুদ্রণ ২০০৫, পৃষ্টা ৭৫, দেজ পাবলিশিং, ১৩, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা), এই পথটিকেই সমর্থন করে। সুতরাং গাঙ্গুর নদী, ত্রিবেণী, সপ্তগ্রাম সব মিলিয়ে পূর্ব বর্ধমানের কসবা, রণডিহার মধ্যে অবস্থিত চম্পাইনগর গ্রামই চাঁদ সওদাগরের বাসস্থান হবার সর্বপ্রেক্ষা শক্তিশালী দাবিদার।
এখন কথা হচ্ছে রণডিহার কাছে তো গঙ্গা নয়, দামোদর বইছে। আসলে প্রাচীন দামোদর নদের প্রধান ধারাটি বর্ধমানের কাছে পূবমুখী হয়ে ভাগীরথীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিল।আর দামোদরের দুটি প্রধান শাখা নদী ছিল গাঙ্গুর ও বেহুলা। ১৫৬১ র নাস্টালডির মানচিত্রে বেহুলা ও গাঙ্গুরের খাতকেই দামোদরের মুখ্য জলধারা বলে চিহ্নিতকরণ হয়েছিল(অনির্বান ভট্টাচার্য)। লখিন্দরের শব নিয়ে বেহুলার মান্দাস গাঙ্গুর ও বেহুলার মিলিত জলধারার মধ্য দিয়েই ভেসে গেছিলো এবং পৌঁছেছিল ত্রিবেণীতে। কালপ্রবাহে দামোদরের মূলধারার জল শুকিয়ে যায়, নাম হয় কানা দামোদর। এর সঙ্গে শুকিয়ে যায় বা মজে যেতে থাকে মনসামঙ্গলের গাঙ্গুর ও বেহুলা নদী।যদিও কসবা চম্পাইনগরে এখনও শীর্ণকায়া গাঙ্গুরের সাক্ষাৎ মেলে।
মনসামঙ্গল কাব্যের একাল- চাঁদ-বণিকের দেশে। দ্বিতীয় পরিচ্ছদ।
তাই সপ্তাহান্তের ছুটিতে টাইম মেশিনে চেপে চলুন সেকালের মঙ্গলকাব্যের চাঁদ বণিকের খোঁজে, বেহুলা লখিন্দরের অমর প্রেমের সন্ধানে , একালের কসবা চম্পাইনগর, পানাগড় , পূর্ব বর্ধমানে।
পূর্ব রেলের বর্ধমানের পরে, দুর্গাপুরের আগে পানাগড় এক উল্লেখযোগ্য জায়গা। এর গুরুত্ব আরো বেশি সেনা ছাউনির জন্য।পানাগর স্টেশনে নেমে হেঁটেই চলে আসুন পানাগড় বাজার। অথবা কলকাতা থেকে বাসেও আসতে পারেন। আগে বাসগুলি পানাগড় বাজার দিয়েই আসতো, এখন ব্রীজের ওপর দিয়ে চলে যায়। কন্ডাক্টর কে বলে বুদবুদ বাইপাস মোড়ে নেমে যে কোন লোকাল বাসে চলে আসুন পানাগড় বাজার মোড়ে। জি টি রোড থেকে চাঁদ সওদাগরের নিবাস চম্পাইনগর যাবার বাস পাবেন, দুর্গাপুর/বেনাচিতি/আসানসোল - কসবা লেখা থাকবে।এছাড়া সামান্য কিছু ট্রেকার, ভটভটি রিকশা, টোটোও যাতায়াত করে এই পথে। পানাগড় বাজার থেকে প্রথম ৩/৪ কিমি রাস্তার হাল খুব খারাপ।তারপর অবশ্য রাস্তা মোটামুটি ভালোই।কসবায় নেমে সামান্য হাঁটতে হবে চাঁদ বণিকের ঠিকানা চম্পাইনগর যাবার জন্য। লাল মোরাম বিছানো এই সুন্দর মাটির রাস্তাটি আপনার মন ভালো করে দেবে।দুধারে গাঢ় সবুজ রঙের গাছ পালা ও চাষের জমি, মধ্যে মধ্যে ঘন ও দীর্ঘ কাশঝোপ, সারা রাস্তা কত জানা অজানা পাখির কল কাকলিতে মুখর।মোলাকাত হবে মনসামঙ্গলে বর্ণিত গাঙ্গুর নদীর সঙ্গে।এই সেই গাঙ্গুর নদী, যাঁর মধ্য দিয়ে চলাচল করত, সপ্তডিঙ্গা মধুকর।আজ বয়সের ভারে গাঙ্গুর শীর্ণকায়া, নালার রূপ ধারণ করেছে। আপনার গলায় সুর থাক বা না থাক, পথ চলতে চলতে আপনার মন বলে উঠবে- গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে ! হঠাৎ করে ডানদিকে চোখে পড়বে এক বিশালকায় বট বৃক্ষ।অসংখ্য ডালপালা ছড়িয়ে বিরাট জায়গা জুড়ে তার রাজত্ব।বটগাছের মধ্য দিয়েই দেখা যাচ্ছে একটি টিলা ও টিলার মাথায় এক মন্দির।কি অসাধারণ শান্ত নিঝুম পরিবেশ। বট গাছটি যেন যুগ যুগান্ত ধরে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে মন্দিরটিকে। দেখেই ভালো লেগে গেল জায়গাটি। ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে টিলার গা বেয়ে মন্দিরে। পৌঁছুলাম সিঁড়ি বেয়ে টিলার চূড়ার মন্দিরে।
![]() |
চাঁদ বনিকের শিবমন্দির । |
আরে! এ যে এক বিশাল শিবমন্দির। মন্দিরের মধ্যের শিবলিঙ্গটি কি বিশাল আকৃতির, আর কি সুন্দর দেখতে।
![]() |
চাঁদ সওদাগরের পূজিত শিবলিঙ্গ । |
মন্দির চত্বরের মধ্যেই আছে আরেকটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র শিবলিঙ্গ, সামনে নন্দী উপবিষ্ট।মন্দির গাত্রে এই দুই শিব লিঙ্গের পরিচয় দেওয়া আছে শ্রী শ্রী রামেশ্বরজিউ ও বানেশ্বরজিউ বলে।বুঝতে পারলাম পৌঁছে গেছি অভীষ্ট স্থানে, এই সেই চাঁদ সওদাগরের প্রতিষ্ঠিত শিব মন্দির ও শিব লিঙ্গ। তবে মন্দিরের প্রাচীনত্ব নষ্ট হয়ে গেছে।মন্দিরটিকে দ্বিতীয়বার সংস্কার করা হয় ২০০৬ সালে। প্রাচীন মন্দিরকে বাঁচাতে গিয়ে আধুনিক রূপদান বেদনাদায়ক। হয়ত এছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না। সে যাকগে ! দর্শন তো হলো।
![]() |
চম্পাইনগরের প্রাচীন মনসা মন্দির । |
পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভর দুপুর, মন্দির প্রায় শুনশান। পুরোহিত মশাই গেছেন দ্বিপ্রহরের ভোজনে। তবে এক বিয়ের পার্টি বসে আছে, পুরোহিত এলে শুভকর্ম শুরু হবে।
নিচে নেমে , এক হালকা ঝোপ পেরিয়ে এলাম এক ভগ্ন পাথরের কাছে।আমার সঙ্গে আছেন স্থানীয় ভরতপুর গ্রামের তরুণ গাইড শ্রী রণজিৎ রুইদাস(৯৯৩২৬৯০৬৭২)। ওঁর কাছে শুনলাম যে এই পাথরটির নাম স্থানীয়দের কাছে" মাথা কাটা শিব"।
![]() |
মাথা কাটা শিব । |
কেন এই নাম এ নিয়ে গাইডের কাছে এক প্রচলিত কথা শুনলাম। চাঁদ সওদাগর প্রাণ মনে শিবের ভক্ত। আর সেই শিবঠাকুড়ই কিনা চাঁদকে এমন কথা বলছেন- "কি দরকার বাপু ওই খেপির সঙ্গে বিবাদ জিয়ে রাখার, তোমার তো কত ক্ষতি করেছে, আরো কত করবে তার ঠিক কি! করো না বাপু একটি বারের জন্য নম নম করে ওর পুজো।"
চাঁদ প্রথমে স্তম্ভিত পরে ক্রুদ্ধ, যাঁকে ছাড়া জীবনে অন্য কারো পুজো করেননি, সেই প্রভুর মুখে একি কথা ? ক্রুদ্ধ চাঁদ দণ্ডের আঘাতে শিবলিঙ্গের মতন দেখতে এই পাথরটিকে ভেঙে ফেলেন। তাই এই ভগ্ন পাথরটির লৌকিক নাম হয়, মাথা কাটা শিব। মাথা কাটা শিবের সামনেই এক মা মনসা মন্দির। আর এখান থেকে কাশের ঝোপ সড়িয়ে সামান্য গিয়েই ডানদিকে পড়লো এক অতি প্রাচীন চমৎকার টেরাকোটার মন্দির।
![]() |
প্রাচীন টেরাকোটার মন্দির । |
কবেকার মন্দির, কোন দেবতার মন্দির, কে প্রতিষ্ঠা করেন, জনে জনে জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পেলাম না। তবে এখনও কি চমৎকার কিছু টেরাকোটা ফলক বেঁচে আছে।রাধা কৃষ্ণের যুগল টেরাকোটার ফলকটি দেখে হয়ত প্রাচীন মন্দিরের গর্ভ গৃহে কেউ হাল আমলের রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তি রেখে দিয়েছেন। এই মন্দিরের বিপরীতে ৫০ ফুট মতন দূরে, চম্পাইনগরের পায়ে চলার পথের ঠিক নীচে এক অতি প্রাচীন সম্ভবত চার চালা মনসা মন্দির- ধুলিস্মাৎ হবার দিন গুনছে।সম্ভবত শব্দ ব্যবহার করলাম কারণ মন্দিরের ছাদে এত আগাছা জন্মেছে যে, ঠিক করে বোঝাও যাচ্ছে না, চার চালার ওপরেও আরো চালা ছিল কিনা।আশ্চর্যের ব্যাপার, প্রাচীন মন্দিরের সংস্কার না করে এর সামনেই একটি আধুনিক মনসা মন্দির প্রতিষ্টা করা হয়েছে।
কাকতলীয় ভাবে প্রাচীন মনসা মন্দিরের ভাঙা দেওয়ালের মধ্য থেকে একটি সাপ বেরিয়ে এসে, বিদ্যুৎ গতিতে ধানজমির মধ্যে লুকিয়ে পড়লো। আমরা নির্ঘাত ওদের শান্ত জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছি।
চাঁদ বণিকের ছয়টি পুত্রকে মনসা হত্যা করেন এ-গল্প তো সবারই জানা। শেষ পুত্র লখিন্দর ও তাঁর সদ্যবিবাহিতা পত্নী বেহুলাকে সাপের কামড়ের হাত থেকে বাঁচাতে যে লৌহনির্মিত বাসর ঘর তৈরি করিয়েছিলেন চাঁদ সওদাগর, সেটিও সকলেরই জানা। আমরা এখন চলেছি সেই বাসর ঘরের দিকে। অবশ্য বাস্তবের এই বাসর ঘর মৃত্তিকা এবং ইষ্টক নির্মিত।ধাপে ধাপে চড়ছি এক নাতিউচ্চ টিলার ওপর। চতুর্দিকে অসংখ্য প্রাচীন, বৃহদাকার ইঁট যত্র তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।কোন কোনটি তার ১৬" × ১০" চওড়া। বেশিরভাগ ইঁটের রঙ লাল তবে বেশ কিছু কালো রঙের ইঁটও চোখে পড়ল।আসলে আমরা বাসর ঘরের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছি।টিলার টঙেই সতী বেহুলার মন্দির। মন্দিরে বেহুলা-লখিন্দর, চাঁদ সওদাগর এবং মনসা দেবীর মাটির মূর্তি রাখা। মন্দিরের সামনে ডানদিকে আছে এক বিশাল শিলপাটা। এখানে আপনাদের অবগতির জন্য জানাই যে, রাঢ়বঙ্গের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শিলনোড়া কিন্তু মা ষষ্ঠীর রূপক এবং সদ্য বিবাহিতা নারীর হাতে অনেক জায়গায় নোড়া ধরানো হয়, ষষ্ঠী ঠাকরুনের কৃপায় বধূ যেন সন্তানবতী হয় এই কামনায়।শুনলাম যে এখনও অনেক নববধূ এই শীল পাটা স্পর্শ করে যায়।
![]() |
টঙ্গের উপরে বাসর ঘর । |
এই অতি প্রাচীন ইঁট গুলি দেখে, চিন্তা ভাবনা সব যেন কেমন গুলিয়ে যেতে লাগলো। মনসামঙ্গল যদি কেবলই লৌকিক কাব্য হয় তবে এই বৃহৎ ইঁটের ঢিবি, গাঙ্গুর নদী, বিশালকায় শিবলিঙ্গ- এগুলি তো ঘোর বাস্তব। তাহলে কি যুগ যুগ ধরে প্রচলিত অলৌকিক কাহিনী আর বিশ্বাস আদতে বাস্তবের জমির মধ্যেই প্রোথিত ছিল ?
যদিও কিছটা প্রক্ষিপ্ত ঘটনা, তবুও আরেক বিস্ময় চোখে পড়লো বাসর ঘরের সামান্য দূরে। বিশাল বিশাল ইঁট ও চুন সুরকির গাঁথনীর প্রাচীন চৌবাচ্চা। এরকম চৌবাচ্চা অজয়ের ধারে আগেও দেখেছি। তাই দেখেই চিনতে পারলাম যে এই বিশাল চৌবাচ্চায় নীল গাছ ভেজান ও ফোটান হতো। আদতে এটি একটি প্রাচীন নীলকুঠি। বন্ধুবর এবং বিশিষ্ট ক্ষেত্র সমীক্ষক শ্রী প্রণব ভট্টাচার্য এবিষয়ে অনেক আলোকপাত করেছেন। একদা দামোদর এবং গাঙ্গুরের পতিত জমিতে প্রচুর নীল চাষ হতো। সেই সব নীল রপ্তানি করবার জন্য কসবা গ্রামের পাস দিয়েই , সিলামপুর থেকে সম্ভবত বর্ধমান অবধি ন্যারো গজ রেললাইন দিয়ে মালগাড়ি চলতো।বছর ২০ আগেও সেই রেল লাইনের কিছু কিছু অংশ দেখা যেত।১৮৬২ সালের নীল বিদ্রোহের অন্তে কুখ্যাত নীল চাষ আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। তাহলেই ভাবুন চম্পাইনগর বেড়াতে এসে আপনি প্রত্যক্ষ করতে পারবেন কম করে ১৮৬২ সালের আগের ইতিহাসের এক অধ্যায়।
![]() |
ইংরেজ আমলের নীলকুটি । |
চাঁদ বণিকের দেশে কষ্ট করে বেড়াতে এলে কিন্তু আখেরে পুষিয়ে যাবে। বিশেষ করে শীতকালে এলে।এখান থেকে অতি সামান্য দূরে দামোদর নদের ধারে আছে , এক চমৎকার বেড়ানোর জায়গা - রণডিহা। আর যাতায়াতের রাস্তায় পড়বে ভরতপুর নামক এক ঐতিহাসিক স্থান।
![]() |
ভরতপুর স্তূপ । |
এখানে অবশ্যই নামবেন এবং দেখবেন এক অসামান্য ঐতিহাসিক মূল্যের সম্ভবত খ্রিস্টীয় দ্বাদশ/ত্রয়োদশ শতক অবধি অধিবসতির সাক্ষ্য স্বরূপ, কুষান স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত বৌদ্ধ স্তূপ। ১৯৭১ ও ১৯৭৪ সালে এখানে পুরাতাত্ত্বিক খনন কার্য চালিয়ে বহু প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার হয়। এর পরে আর কিছু হয়নি, এই ঐতিহাসিক স্তুপ এখন অবহেলার শিকার।চতুর্দিকে ৭০০/৮০০ বছরের প্রাচীন , পূর্বজদের দৈনন্দিন ব্যবর্হিত সামগ্রী মাটির হাঁড়ি- কড়াই - বাসনপত্র- থালা-বাটি- গ্লাস, পায়ের নিচে আমাদেরই পায়ের চাপে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। বুকের ভিতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো, আজ আমরা নির্দ্বিধায় পূর্বজদের গড়া সভ্যতা কে পদদলিত করছি, মহাকালের রথের ঘোড়া কিন্তু একদিন এর প্রতিশোধ নেবেই নেবে।
তথ্য সূত্র:-
১)মঙ্গলকাব্যে লোকজীবন ও লোক ধর্মভাবনা। অমিতাভ গোস্বামী।
২)মনসামঙ্গলের ভৌগোলিক পটভূমি, অনির্বান ভট্টাচার্য। ঋদ্ধি , আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা: ১, বর্ষ ১৩।।সংখ্যা ২১।। সেপ্টেম্বর, ২০১৭।
৩)মনসামঙ্গল উইকিপিডিয়া।
৪পদ্মাপুরান বা মনসামঙ্গল, কবিবর ৺বিজয় গুপ্ত প্রণীত, চতুর্থ সংস্করণ।শুধাংশু সাহিত্য মন্দির।
৫)নীহাররঞ্জন রায়- বাংলার ইতিহাস, আদি পর্ব( প্রথম প্রকাশন ১৯৭২, পুনর্মুদ্রণ ২০০৫, পৃষ্টা ৭৫, দেজ পাবলিশিং, ১৩, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা)
৬)বাংলা মঙ্গলকাব্যে লৌকিক উপাদান। ডা: ইন্দুভূষণ মন্ডল।
৭)সাপ নিয়ে কিংবদন্তি। অবণীভূষণ ঘোষ, অমিয়কুমার হাটি, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। কথাশিল্প, ১৯, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা।
No comments:
Post a Comment