Saturday, June 27, 2020

বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।

বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।
বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।ছবি-লেখক
চলুন আমার সঙ্গে আমার দেশ, আমার বাংলা, আমার ভারতবর্ষের দর্শনে,  ধামসা মাদলের খোঁজে- বাঁকুড়া জেলার  সাঁওতাল আদিবাসী অধ্যুষিত বাঁশকানালি গ্রামে। এখানে প্রতি বছর  বুদ্ধ পূর্ণিমার পরের পূর্ণিমায়  অনুষ্ঠিত হয় "বাহা- মা: মড়ে অনুষ্ঠান"।

সাঁওতাল উপজাতিদের নিয়ে কিছু বলা যাক।এরা বিশ্বাস করে এদেরই পূর্বপুরুষ ছিলেন একলব্য, যাঁকে অত্যন্ত অন্যায় ভাবে দ্রোনাচার্য তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুল গুরুদক্ষিণা হিসাবে চেয়েছিলেন। তাই জানেন কিনা জানিনা, আজকেও সাঁওতালরা তীর ছোড়ার সময় বুড়ো আঙুল ব্যবহার করে না। অবশ্য এরকম অন্যায় কাজের উদাহরণ তো আমাদের দেশে ভুরি ভুরি ঘটেছে- শত শত একলব্য, শম্বুকদের কথা আর কেই বা মনে রাখে !






বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।

সাঁওতালরা - কিসকু, মুর্মু, হাঁসদা, সরেন,
টুডু,মানডি, বাস্কে , বেদিয়া, বেসরা, পাউরিয়া, চোঁঁড়ে, হেমব্রম এই বারোটি পারিস বা গোষ্ঠী বা গোত্রে বিভক্ত। আরেকটা কথা- সাঁওতালরা প্রকৃতির উপাসক, মূর্তি পুজো করেনা। 

সাঁওতাল নামে এঁদের পরিচিতি পরে হয়েছে, আদিতে একদা ১২ টি বিভিন্ন জাতি- কোল, ভীল, মুন্ডা, ওঁরাও, কুর্মি, সাঁওতাল, বিদিয়া, বিড়হড়, কোড়া, গন্ড, দেশওয়ালী এবং মাহালি- এঁদের নিয়েই ছিল বৃহত্তর খেরওয়াল গোষ্ঠী। পরে এরা ভাগ হয়ে যায় ভিন্ন ভিন্ন জাতি হিসাবে। 

সাঁওতাল উপজাতিদের বাহা- মা: মড়ে উৎসবে মেতে ওঠার আগে এবং কিছু বলার আগে রাঢ় বাংলা এবং বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কিছু দরকার আছে বলে মনে হয়।
 আমরা বাঙালিরা গর্বিত আর্য জাতি, আমাদের নিয়ে কবি লেখেন-" মোক্ষ মুলার বলেছে আর্য,/ সেই থেকে মোরা ছেড়েছি কার্য।"

দেখে নিই আমরা কতটা আর্য, আর যাঁদের আমরা অনার্য বলছি, তাঁদের নিয়েও কিছু আলোচনা করছি। আর্য জাতি তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে যখন ভারতে, ভালো করে বললে উত্তর ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত আছে, বাংলাদেশে তখন আদিতম দ্রাবিড় গোষ্ঠী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিম জনজাতি গোষ্ঠী বা প্রটো অস্ট্রোলয়েড গোষ্ঠীর লোকেদেরই বসবাস। এরা ছিল অতি উন্নত জাতি, এরা অস্ট্রিক ভাষায় কথা বলত।

পরবর্তী কালে  অবৈদিক আর্য যেমন আলপিও, দিনারিও ইত্যাদি জন গোষ্টিও বাংলার মাটিকে বাসভূমি হিসাবে গ্রহণ করে থিতু হয়ে বসে। এই দ্রাবিড় এবং মুখ্যত অবৈদিক আর্য আলেপিও , দিনারিও গোষ্ঠীর লোকেদের সঙ্গে অস্ট্রিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারক গোষ্ঠীর মিলনের ফলেই আজকের বাংলাদেশের বাঙালি গোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক উৎপত্তি। অর্থাৎ বাঙালি হচ্ছে মিশ্র শংকর জাতি।বৈদিক আর্যদের বঙ্গ বিজয় এবং বৈদিক সংস্কৃতির আবির্ভাব এর অনেক পরের ঘটনা।বঙ্গ সংস্কৃতিতে অনার্য প্রভাব নিয়ে বলা যায় যে নৃতাত্ত্বিক ভাবে বাঙালি যে উন্নত জাতি তার কারণ হচ্ছে, বাঙালির রক্তে আছে তিনটি সভ্যতার - প্রোট অস্ট্রোলয়েড, দ্রাবিড় এবং মিশ্র আর্যভাষী- সভ্যতার মিশ্রণ। তাই বঙ্গ সংস্কৃতি বলতে কেবল ব্রাহ্মণ‍্য সংস্কৃতি আদৌ বোঝায় না। এর পরতে পরতে মিশে আছে আদিম জনজাতি, অবৈদিক সভ্যতার প্রভাব। 

তাই বিদেশি পন্ডিতেরা যখন বলেন বহিরাগত আর্যদের দ্বারা ভারতবর্ষের সু সভ্যতার প্রচলন ঘটেছে , তখন বোঝা যায়,এনাদের চেতনায় ছড়িয়ে আছে, ভারতীয়দের সম্মন্ধে এক তুচ্ছতাচ্ছিল্য মনোভাব। বাইরের সভ্যতার সংস্পর্শে এসেই ভারতীয়রা সভ্য হয়েছে। এর থেকে মিথ্যা মিথ আর হয়না- অতি উন্নত সিন্ধু সভ্যতার প্রচলন কারা করেছিল ? কোথায় ছিল তখন সভ্য আর্যরা ?
সুর- অসুর, আর্য-অনার্য  ইত্যাদি শব্দগুলি নিয়ে চমৎকার নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন  সুহৃদকুমার বাবু তাঁর আর্য রহস্য বইয়ে। তাঁর লেখা কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি-" আমরা সকলেই জানি যে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর কিছুই নয়, খুব কম হলেও চারটি মৌলিক ভাষা-গোষ্ঠীর মানুষের সমবায়ে গঠিত এক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। কাল অনুসারে তারা হল অস্ট্র-এশিয়াটিক কোল গোষ্ঠী
, দ্রাবিড়, ইন্দো- যুরোপীয় বেদিয়া শ্রেণী ও ভোটচিনীয়।। ম্যাক্স মুলরের সময় থেকে বিনা কারণে যাযাবর জাতিটি সহসা আর্য নামে অভিহিত হতে লাগল।ঐ যাযাবর জাতিটি ছাড়া অপর সকলেই ছিল স্থায়ী বসবাসকারী কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠী। আর যাযাবর বেদিয়ারা স্থায়ী বসবাসকারী মানুষের কাছে আসত ঔষধ বিক্রয় করতে, তুকতাক করতে আর সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য দুর্বোধ্য সব জাদুমন্ত্রে ভগবানকে ডাকতে।....."


 বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া । মোড়ল মশায়ের বাড়ীতে।

রাত প্রায় আটটা, আমরা এসে পৌঁছেছি , বাঁকুড়া জেলার সাঁওতাল আদিবাসী অধ্যুষিত বাঁশকানালি গ্রামে । এখানে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বাহা- মা: মড়ে অনুষ্ঠান , প্রথম দিনের অনুষ্ঠান হবে ওঁদের পুরোহিত বা নাইকির বাড়ীতে। সিমলাপাল থেকে এই গ্রামের দূরত্ব ১০ কিমি র মতন।
আমরা  উঠেছি,  শ্রী মহেন্দ্রনাথ সরেন এই বাঁশকানালি গ্রামের মোড়লের বাড়িতে। এনার ছোটভাই ডাক্তার এবং আমার স্ত্রীর সহকর্মী। ডাক্তার ও সপরিবারে এসেছে। একগাড়ি পল্টন এসে তিনদিনের জন্য খুঁটি গেড়ে বসলাম, মোড়লের বাড়িতে। কিন্তু মোড়ল ই তো এই আনন্দ উৎসবের মুখ্য হোতা। আমাদের সামলাবে কে ? কুছ পরোয়া নেই, মোড়ল মশাইয়ের বৌদি, আমাদের সবার বড় বৌদি, সদা হাস্যময়ী , সাক্ষাৎ মা অন্নপূর্ণা- মকরি সরেন বৌদি স্বেচ্ছায় সব ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। তার আগে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা এসে সোনা রঙের কাঁসার ঘটি থেকে জল ঢেলে, কাপড় দিয়ে পা মুছিয়ে দিয়ে, একে একে সবাই ভূমিষ্ট হয়ে প্রনাম করল। কিচ্ছু করার নেই, এই রীতিই এখানকার দস্তুর। সরল আদিবাসীদের এই অকৃত্রিম ভালোবাসায় চোখ ভিজে উঠবে। নব্য বঙ্গজদের কাছে, এসব হয়ত ফালতু মনে হবে। বাচ্চা মেয়ে বলতে যাঁদের বুঝিয়েছি, সেই শান্তি হেমব্রম, শ্যামলী সরেন ইত্যাদি ভাইজি, ভাগ্নীরা সবাই কমপক্ষে এম এ পাস এবং স্কুল শিক্ষিকা।

বিশাল উঠোন, পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। সারি সারি খাটিয়া পাতা। এতেই চলেছে, গান, আড্ডা, নাচের মহড়া। তালবাদ্যের রণ সংগীতে, এর মধ্যেই রক্ত গরম হতে শুরু করেছে। ঝকঝকে নিকানো উঠোনে, এই বাড়ির মেয়েদের হাতে বোনা আসনে বসে, বড় বৌদির হাতের অমৃত সম রান্নার স্বাদ, সারা জীবনের মণিকোঠায় তোলা থাকলো।

মোড়ল মশাইকে ঘিরে গল্প শুনছি। ঠিক গল্প নয়, অজানা সংস্কৃতির গল্প। এই গল্প আমাদের শোনানো হয়না। যে অস্ট্রিক সভ্যতা- ভারতীয় সভ্যতার অন্যতম ভিত্তি, তাঁদের কথা তাঁদের উত্তরসূরিদের মুখ থেকেই শোনা যাক।
মহেন্দ্রনাথ সরেন হচ্ছেন মোড়ল বা মাঝি হাড়াম। ইনি হচ্ছেন এই গ্রাম সমাজের মুখ্য কর্তা। এ ছাড়াও আরো চারজন কর্তা আছেন। পারানিক বা পরামানিক , পরামানিকের সহকারী- জগ পারানিক,  গোড়ায়েৎ বা কাইলি( উৎসবের বার্তাবাহক), জগ মাঝি( মরাল পুলিশ বলা যায়)।
এই যে বাহা- মা মড়ে অনুষ্ঠানে আমরা এসেছি, এর নির্ঘন্ট কিন্তু তৈরি করেছেন- সমাজ কর্তারা মিলে ।  একটি (জেনারেল বডি মিটিং) আলোচনা সভা বা " কুলহি দুড়ুপ:" এ বসে এই নির্ঘন্ট তৈরি হয়েছিল।

মা: অর্থ জাহেরআয়ু মা, যিনি আবার সৃষ্টিকর্তা মারাং বুরুর স্ত্রী। আর মড়ে অর্থ পাঁচ। বৃহত্তর অর্থে পাঁচ ঠাকুরের কাছে মানসিকের কমপক্ষে পাঁচটি পাঁঠা/ছাগল বলি। বসন্ত উৎসবের বা ফুলের উৎসবের অনুষ্ঠান বাহা পরব তো চৈত্র মাসে হয়ে গেছে। কিন্তু বংগা দেবতার থানে যারা মানসিকের ব্রত করেছিল, সেই মানসিকের ব্রত রাখা মানুষ গুলির জন্য, বুদ্ধ পূর্ণিমার পরের পূর্ণিমায় এখানে পালন করা হয় মা: মড়ে উৎসব। মারাং বুরু, জাহেরআয়ু, মড়ে-কো-তুড়েইক, সেন্দ্রা বঙ্গা, হারাং বঙ্গা- এই পাঁচটি মুখ্য দেব-দেবীর থানে চারটি পাঁঠা ও একটি ছাগি বলি হচ্ছে পুজোর অঙ্গ। জাহের আয়ু দেবীর নামে ছাগি বলি হয়।

এক সময়ে মা- মড়ে পুজোর সূচনায় বা কুটাম ডাংরিতে গো দান করা হত। এখন মূল্য ধরে দেওয়া হয়।
এই মুখ্য দেবতাদের থানেই আছেন রস্কে বঙ্গা। ইনি সাঁওতাল সমাজের রসে বসে থাকা আনন্দের ঠাকুর বলতে পারি।
বাঁয়ে ধামসা, ডাইনে রেগরা বাদকের দল।
এই বলি উৎসব কিন্তু হবে দ্বিতীয় দিনে, অর্থাৎ আগামীকাল, যাকে বলা হয় সারদি-র দিনে।
১ ম দিনের পু জো শুরু হয়েছে, ছবি লেখক।
রাত নয়টায় ঢুকলাম- প্রধান পুরোহিত বা নাইকির বাড়ির উঠানে। লোকে লোকারণ্য। দুই দিকে বাজনাদারেরা বসে গ্যাছে তাঁদের বাজনার যন্ত্র নিয়ে।আরেকদিকে মেয়েরা বসে । আধো অন্ধকারে এক আধি দৈবিক, আধি  ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ধামসা, মাদল, রেগড়া, সাঁকোয়া কত রকম বাদ্যযন্ত্র , বিশাল জায়গাজুড়ে কি অসাধারণ একটি পরিবেশ তৈরি করেছে, লিখে বোঝান যাবেনা। তিনদিনের উৎসবের আজকে অনুষ্ঠানের প্রথম দিন, ওঁরা বলেন 
ওঁম ।
বাঁ দিকে মুখ্য পুরোহিত বা নাইকি- বীরেন সরেনের ঘর। মূল ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছে, নাইকির উঠানের তুলসী মঞ্চ ঘিরে। নাইকির সহকারী একটি কম বয়সী ছেলে- যাকে ডাকা হয় " কুডম নাইকি" বলে।
একদিকে পুজো আর্চা চলছে, মাঝে মধ্যে ধুনোর ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। সমস্ত ইলেকট্রিক আলো নিভিয়ে দিয়ে একটিমাত্র হ্যাজাকের আলোতে এতবড় অনুষ্ঠান চলছে।
রাত ১ টা বাজে, অনুষ্ঠান চলছে।

ধামসা, মাদল, খোল এগুলি সবই হচ্ছে আনন্ধ শ্রেণীর বাদ্যযন্ত্র, অর্থাৎ প্রতিটি বাদ্যযন্ত্র চামড়ার আচ্ছাধন দিয়ে তৈরি। 
ধামসা বা নাগারা আদিতে রণসঙ্গীত হিসাবে যুদ্ধের সময় বাজানো হত। তবে বর্তমানে মানভূম এবং ছোটনাগপুর জেলার বিভিন্ন নৃত্যগীত এবং শোভাযাত্রায় ব্যাপকভাবে এটি বাজানো হয়। ধামসা বা নাগারার অন্য নামগুলো হচ্ছে টিকারা, দামামা, ঢক্কা, ডঙ্কা ইত্যাদি।

আগে শিশুকাঠ দিয়ে ধামসার খোল তৈরি হতো। তবে বর্তমানে লোহার চাড়ির মুখে গরু বা মহিষের চামড়া দিয়ে এর ছাউনী তৈরি হয়। ছাউনী তৈরিতে গাব(গাব ফলের আঠা) বা খিরণ লাগানো হয় না।
ধামসা দুটি মোটা কাঠির সাহায্যে বাজানো হয়। ধামসা কিন্তু ছোট ও বড় - দুটি মাপের হয়। বোলের শব্দ শুনে দ্রিমি দ্রিমি, দ্রিম দ্রিম ধ্বনি বলে মনে হয়। বাঁশ পাহাড়ির অনুষ্ঠানে দুই সাইজের ধামসা দেখতে পেলাম।

প্রায় এরকমই আওয়াজ বেরোচ্ছে আরেকটি বিশাল বাদ্যযন্ত্র থেকে। এটির নাম রেগড়া। এটি কিন্তু সমান দৈর্ঘ্যের দুটি কাঠি দিয়ে বাজানো হচ্ছে।

বিশাল আকারের মহিষের শিঙে প্রস্তুত আরেকটি বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে সাঁকোয়া। শিঙের মধ্যে একটি ফুটো থাকে। এই ফুটোতেই ফুঁ দিয়ে সুর তুলছে। মধ্যে মধ্যে শিল্পীকে যন্ত্রের মধ্যে জল ঢেলে পরিষ্কার করতে দেখলাম। সাঁকোয়া বহু প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র। একজন শিল্পীর সঙ্গে আলাপ হল- উনার নাম লখিন্দর মুর্মু। উনি এই যন্ত্র বাজাতে শিখেছেন উনার গুরু মহেন্দ্রনাথ সরেনের কাছে।

মহিষের শিঙে প্রস্তুত আরেকটি বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে সাঁকোয়া। 

এবার আসি মাদলে।
মাদল দেখতে অনেকটা সিলিনড্রিকাল , এরকমই দেখতে একটু ছোট বাদ্যযন্ত্র কে লাগা বলে। এটি তৈরিতে পোড়ামাটির খোল লাগে। এখানেও খোলা মুখ দুটিতে গরু/মোষের চামড়ার ছাউনী লাগানো হয়। ছাউনির মাঝখানে গাব ফলের আঠা বা খিরণ লাগিয়ে চামড়া শক্ত ও টেকসই করা হয়। এছাড়া খোলের উপর তবলার মতন সরু সরু চামড়ার ফিতের বাঁধি লাগানো হয়। নাচ গানের সময় বেশির ভাগ জায়গায়, দুটি মাদল এবং একটি লাগা ব্যবহার করা হয়। তাই দুটি মাদল এবং একটি লাগা নিয়ে মাদলের একটি সেট হয়। আদিবাসী নাচে গানে, ঝুমুর গান এবং নাচে, মাদল বাজবেই।

খোলও একটি পোড়ামাটির বাদ্যযন্ত্র। মৃৎ বা মাটির তৈরি বলে এর আরেকটি নাম মৃদঙ্গ। খোলের আকার অনেকটা কলার মোচার আকৃতির। দুই দিকের খোলা মুখ দুটিতে চামড়ার আচ্ছাদন বা ছাউনী লাগানো হয়। ডানদিকের মুখটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র , বামদিকের মুখের চেয়ে। এখানেও চামড়ার মাঝখানে গাব বা খিরণ লাগান হয়।বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে, কীর্তন গানের সঙ্গে খোলের বহুল ব্যবহার করা হয়, তাই একে কীর্তন খোল ও বলে।

রাত একটা বেজে গেছে, , নাচ- গান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছেই। শুনলাম চলবে রাত তিনটে অবধি। অনেকের উপরে দেখলাম দেবতার  ভর হয়েছে। তাঁদের ব্যাবহার ও চলন বলন, কেমন অদ্ভুতভাবে বদলে যাচ্ছে।

 ফিরে এলাম ঘরে। সত্যিকারের রাম রাজত্ব দেখতে হলে এই সাঁওতাল গ্রামগুলিতে আসতে হবে। এত লোক রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে, বাইরে থেকে এত  লোক এসেছে, বাড়ির সামনে থেকে পিছন অবধি সব দরজা/জানলা খোলা। আমি তো চাঁদের আলোয় শুয়ে পড়লাম, উঠানের খাটিয়াতে। শেষ রাতে শুনি মাথার উপরে মোরগের ডাক। তখনও ঠিকমতন আলো ফোটেনি, কিছু বুঝতে না পেরে, মাথার উপরের আমগাছে ,টর্চের আলো ফেলে চক্ষুস্থির। গাছের উপরে কাতারে কাতারে মুরগি চড়ে বসেছে। এমন অদ্ভুত দৃশ্য, জীবনে প্রথম দেখলাম।

আমগাছে মুরগি, বাপের জন্মে দেখিনি।
পরের দিন সকালে এই মুরগি রহস্য উদ্ধার হল। এখানে প্রত্যেকের ঘরেই লড়াকু কাশিপুর মোরগ পোষা হয়। এই মোরগ পোষা হলেও, মোটামুটিভাবে উড়তে পারে। চোর ডাকাত না থাক, মুরগির খোঁজে শিয়াল বা হুরাল প্রায় গ্রামে হানা দেয়। তাই ডারউইন সাহেবের মতকে মেনে নিয়ে এরাও শিয়ালকে কাঁচকলা দেখিয়ে, রাতের বেলা গাছের মগডালে চড়ে বসে থাকে- survival for the fittest . তবে ওদের জন্য সেকেন্ড লাইন অফ ডিফেন্স, নিঃশব্দে একটু দূরে শুয়ে থাকে। কি তাগড়াই দেশি কুকুর। এগুলোকে শিকারের জন্য সঙ্গে নেওয়া হত একসময় বলে, এদের জিনগত পরিবর্তন সাংঘাতিক হয়েছে। পারত পক্ষে গলা দিয়ে আওয়াজ করেনা। কিন্তু শেষ রাতে কালুর ডাকে, রক্ত জল হয়ে গেছিল, যেন হাউন্ড অফ বাসকারভিলের ডাক। আবার জানলাম যে, শিকারে গেলে শিঙ্গা ফোঁঁকার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি এই দেশি কুকুরগুলি একসঙ্গে ডাকতে থাকে।
কাশীপুর মোরগ ব্রিড করা হচ্ছে,


বাহা- মা: মড়ে উৎসবের দ্বিতীয় দিন। বাঁশকানালি, বাঁকুড়া।

আগেই লিখেছি, বাহা- মা: মড়ে উৎসবের দ্বিতীয় দিনটিকে  বলা হয় সারদি।
আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।

বাগানে এত বড় বড় এঁচোর ঝুলছে।

মাছ ধরতে নদীতে যাওয়া।
সকালে উঠে প্রথমে গেলাম সবজি তুলতে, আজ্ঞে হাঁ- সবজি কিনতে নয়, খেত থেকে সবজি তুলতে।
খেত থেকে তোলা সবজি ।
মোড়ল মশাইয়ের বিশাল খেত, তবে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। আর গাছের আম পাড়া হল। দুটি গাছে ১০০ র মতন এচোড় ধরেছে, কিন্তু পাড়তে পারলাম না, এত বিশাল সাইজ, নিয়ে যাব কি করে।এরপর ব্রেকফাস্ট খেতে বসলাম ,মেঝের উপরে হাতে বোনা আসনে, শাল পাতার থালা-বাটিতে। এরা পরিবেশ নিয়ে শুকনো ভাষণ দেয়না। আপনি আচরি ধর্ম পালন করে দেখায়। তাই এত শিক্ষিত ও আধুনিক হয়েও, জঙ্গলে গিয়ে শালপাতা ও নিমের পাতা নিয়ে আসে। এই থালা,বাটি  ঘরে তৈরি হয়েছে, শালের পাতা ও নিম গাছের শুকনো কাঠি বা চাবেচ দিয়ে। থালা বাটি তৈরি করার জন্য রীতিমতো একটি ট্রেনিং ক্লাস নিল ভাগ্নি মিনতি মুর্মু।

শালপাতার থালা বাটি তৈরির ট্রেনিং।
আর মোড়ল মশাইয়ের কাছে শিখলাম, শাল পাতার বিড়ি বা চুটটা বানাবার কৌশল। রোমে গিয়ে রোমান না হলে কি চলে !
শালপাতার চুটা।

রীতিমত ভীতিপ্রদ,  বিশাল চেহারার একটি চ্যাম্পিয়ন কাশিপুর মোরগ, উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টিয়া পাখির মতন ঠোঁট, ময়ূরের মতন লেজ মাটিতে লুটিয়ে চলেছে, উচ্চতায় কম করে ফুট দুয়েক, বয়স শুনলাম একবছর মাত্র। মোরগ লড়াইয়ে ওকে দেখেই, অপনেন্ট পগারপার ।

উঠোনের খাটিয়াতে শুয়ে শুয়ে বাড়ির সবার কাছ থেকে, বঙ্গ সংস্কৃতির এক অজানা পর্বের গল্প শুনছি। আর বড় বৌদি সমানে টুকটাক মুখ চালাবার সামগ্রী সাপ্লাই করে চলেছেন।
 বহিরাগতরা হচ্ছে  দিকু, খালি সাঁওতাল গোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদের পরিচয় দেয় হড়(মানুষ) বলে। এঁদের আদি পুরুষ হচ্ছে পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুরহি। জাতিতে খেরওয়াল।
ওঁদের গানেই আছে-
 " এ বাবা পিলচু হারাম, এ আয়ো পিলচু বুরহি,
জানাম বাবা বেন জানাম কেৎলিঞ, জৌত বাবা বারেন এমাৎলিঞ ।
জৌতি হো জৌতি গে জৌতি খেরওয়াল।"
অর্থাৎ পিলচু বুড়ো ও পিলচু বুড়ি, আমাদের তো জন্ম দিলে। কিন্তু আমাদের জাতি কি ? জাতি হে জাতিই জাতি, খেরওয়াল জাতি তোমরা।


সাঁওতালদের আদি সমাজ হচ্ছে- বিন্দির  হড় সমাজ। পরে আদি সমাজ থেকে বেরিয়ে গিয়ে সাফা  হড় সমাজ ও ইসৈঁঁয়  হড় সমাজ নামে আরো দুটি সমাজ গড়ে ওঠে।
সাঁওতাল সমাজে কিন্তু স্বগোত্রে বিবাহ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এছাড়াও শুনলাম 
বেসরার সঙ্গে টুডু এবং মাণ্ডির সঙ্গে কিস্কু গোত্রের বিবাহ হয়না।
বিন্দি সমাজে ডালার মধ্যে আর সাফা সমাজে বিয়ের মণ্ডপে (মারওয়া) বিয়ে হয়। বিয়েকে বলা হয় বাপলা। ৪/৫ দিন ধরে বিয়ের পরব চলে। এঁদের সমাজে সাত প্রকার নামের বিবাহের প্রচলিত আছে।
১) ঘটকের(রাইবার হারাম)  সম্বন্ধ করা বিয়ে বা দুয়ার বাপলা, এই বিবাহই সবচেয়ে বেশি হয় ।২) ইপতুৎ অর বাপলা,। ৩)শাঁখা বাপলা।, ৪) ঘরদি জায়ায় বাপলা ।, ৫) টুনকি দিপিল বাপলা,(পাত্রী পক্ষ যদি বিয়ে দিতে অসমর্থ হয়, তখন ছেলের বাড়িতে বিয়ে হয়)।, ৬) অর বাপলা।, ৭)আপাঙ্গির বাপলা (অপহরণ করে বিয়ে) ।
দুয়ার বাপলা বিয়ের প্রথমে হয় পাকা দেখা( ঞেপেল), এটি সাধারণত মেয়ের বাড়িতেই হয়, তবে ছেলের বাড়িতেও হতে পারে।এর পরে হয় সামান্য কনেপন বা "গনং এপেম " দেওয়া। সঙ্গে তত্ব হিসাবে মেয়ের মা, মাসি ও পিসীদের জন্য শাড়ি দেওয়া হয় । তবে অনেক সময় গাভী সম্প্রদানের প্রথাও প্রচলিত ছিল , জানতে পারলাম যে মোড়লের ছোটভাই ডাঃ রাজেন্দ্রনাথ সরেন, তাঁর বিয়েতে দুধেল গাই দিয়েছিলেন। ওঁর স্ত্রী শ্রাবনীর মুখে এই কথা শুনে সমবেত স্রোতাদের মধ্যে  হাসির রোল পরে গেল।
এরপরে মেয়ের বাড়ির মত নিয়ে একদিন ঘটক কনে ও তার গুটিকয়েক বান্ধবীকে , বরের বাড়িতে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে যান। এই অনুষ্ঠানকে বলে কিচরিচ বান্দি। শেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে বালায়া জহার। মেয়ের বাড়ির লোকেরা ছেলের বাড়িতে গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচিত হন। বরকে নতুন ধুতি পরিয়ে ভোজের( জমঞু) অনুষ্ঠান হয়। 
শেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে বিবাহ মণ্ডপ বা " মারোয়া" তৈরি করে দুই বাড়িতেই তেল-হলুদ মাখান বা " তেলাই দান" পর্ব। আর রয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠানে কুলোর মধ্যে ধান-দূর্বা, আতপ চাল, মিষ্টি ইত্যাদি রেখে বরণ করা । কুলোকে সাঁওতালরা মনে করে লক্ষ্মীর চিন্হ, এবং ধান - দূর্বা দিয়ে বরণ করলে ধরা হয়, নবদম্পতি দীর্ঘায়ু ও সুখী হবে। যে কোন আদিবাসী বিয়ের মুখ্য অনুষ্ঠান হচ্ছে সিঁদুর দান। তাহলে মোড়ল মশাইয়ের কাছ থেকে কি জানলাম ? জানলাম যে আমাদের হিন্দু বিয়ের লোকাচার তেল-সিঁদুর মাখান, ধান- দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করা এবং সর্বোপরি সিঁদুর দান- এগুলি সবই আদতে অস্ট্রিক সভ্যতার দান । কৃষিকার্জ যেহেতু অস্ট্রিক সভ্যতার দান, তাই চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত কত অস্ট্রিক শব্দ যে আমরা ওঁদের কাছ থেকে পেয়েছি, আমরা নিজেই তা জানিনা, যেমন- লাঙ্গল, ধান, বেগুন, পান, লাউ, নারকেল,হলুদ, সুপারি, কাপাস, পাট, বাছুর, দা, করাত, ঢেঁকি, মুড়ি- এ শব্দ রাশি শেষ হবার নয়। এমনকি বঙ্গ , গঙ্গা ইত্যাদি নামগুলিও আদতে অস্ট্রিক শব্দ।

আরো দুটি বিয়ের কথা জানলাম। বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ের বিয়েকে বলে সাঙ্গা। আর একবাড়ির ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে অন্য বাড়ির মেয়ে ও ছেলের পালটি বিয়ে হচ্ছে " গোলাত" বিয়ে। 
এরপর যখন কোন সন্তান জন্মায় তখন সারা পরিবার শুধু নয়, পুরো গ্রামে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়, কারণ এঁদের শিশু জন্মহার বেশ কম। বাচ্চার মাথার বালিশের নীচে অপদেবতার প্রভাব কাটাতে একটি লোহার টুকরো রাখা হয়। সুবিধা মতন ১/২/৩/৫/৭ দিন পরে ঘরদোর গোবর দিয়ে তকতকে করে নিকানো হয়। বাচ্চাটার মস্তক মুন্ডন ও নখ কাটার জন্য আসে নাপিত। জিওণগাডা বলে একটি লোকাচার অনুষ্ঠান হয়, সকালে হয় নিমপাতা সহ খিচুড়ি রেঁধে খাওয়া। পরে হয় মুড়ি সহযোগে হাঁড়িয়া পান। প্রথম সন্তান ছেলে হলে ঠাকুরদা ও মেয়ে হলে ঠাকুমার নামে নামকরণ করা হয়। বেশিরভাগ বাড়িতে পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে ৬ মাসে এবং কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে ৭ মাসে অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠিত হয়।
আর সাঁওতালদের মধ্যে কেউ মারা গেলে দাহকার্য এবং কবর দেওয়া প্রচলিত আছে। গর্ভবতী নারী এবং শিশু মারা গেলে কবর দেওয়া হয়, অন্যথায় দাহ করা হয়। সাধারণত বড় ছেলে মুখাগ্নি করেন, অভাবে মৃতের নিকটজন কেউ। অস্থিভস্ম আর কাদা মিশিয়ে একটি তাল বানিয়ে মাটির হাঁড়িতে পুড়ে বাড়ির চালে বা মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। পাঁচদিন পরে হয় " তেলনাহান" অনুষ্ঠান। অস্থি কলস সাধারণত কোন নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।বাড়ির সবাই চুল, নখ, দাড়ি কেটে, স্নান করেন।
এরপর ১৫ দিনের মাথায় হবে শ্রাদ্ধ বা " ভাড়াঁঁন" অনুষ্ঠান। গোবর লেপা উঠোনে একটি সজনে গাছের ডাল পুঁতে অনুষ্ঠান স্থল তৈরি করা হয়। মারাংবুরু এবং পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে মুরগি, ছাগী, শুকরী শেষে পায়রা বলি হয়। আর পুজোর প্রসাদের সঙ্গে থাকে হাঁড়িয়া।

সাঁওতাল সমাজে অসংখ্য পরব। অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন, ফাল্গুন মাসে দোল(বাহা)- ছাড়াও আরো অনেক পরব উদযাপিত হয়। যেমন আষাঢ় মাসে এরক- সিম, ভাদ্রমাসে গুণ্ডলী, অগ্রহায়ণ মাসে যন্থর পুজো, পৌষ সংক্রান্তিতে সংক্রান্ত পুজো, মাঘ মাসে- মাঘ সিম পুজো ইত্যাদি। আমার ছোটবেলায় আষাড়িয়া সিম পুজো তো চাষের জমিতে হতে দেখেছি।  আষাড় মাসে, জলভরা কাদা জমিতে ধান চারা রোপন করার আগে এই খেত পুজো হত।
শিলাবতী নদীতে ঘুরে আসা গেল।

কিছুক্ষণের জন্য শিলাবতী নদীতে ঘুরে আসা গেল, জল প্রায় নেই।
তারপর কানে ভেসে এল জাহেরআয়ু থান থেকে ধামসা- মাদলের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। ছুট-ছুট জাহেরআয়ুর থানে।
  ধামসা- মাদলের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ।

কাতারে কাতারে লোকে এসে ভীড় জমিয়েছে। একটি মাচা বানিয়ে তার উপরে শাল পাতা, শাল ফুল, মহুয়া ফুল, আমপাতা দিয়ে সাজান হয়েছে।
মাচার নীচে পুজোর আয়োজন।

মাচার নীচে পুজোর আয়োজন। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে মেয়েরা হাতে হাত ধরে নাচ করছে।


হাতে হাতে ধরি ধরি।
কি অসাধারণ সেই পরিবেশ। বলির পরে হল , মাংস ও খিচুড়ি ভোগ।কি দারুন লাগছিল এই সহজ সরল মানুষগুলির সঙ্গে বসে পঙক্তি ভোজ খেতে। এরপরে বলির উদ্বৃত্ত মাংস সবার বাড়িতে বিতরণ করা হল, জানিয়ে রাখি এই বাঁশকানালি গ্রামে সর্বমোট ৮৫ টি বাড়ি আছে। অনুষ্ঠানের সমস্ত খরচ প্রতিটি বাড়ির লোকেরা সমান ভাবে বহন করে। কোন রকম চাঁদা তোলা বা নেওয়া হয়না। তবে নাচ গানের আসরে আপনি টাকা দিলে, ওরা মাইকে অ্যনাউন্স করে আপনার দান গ্রহণ করবে।

নাচের আইটেম পাঞ্চি শাড়ি ও পাঞ্চি ধুতি। 

ফেরার সময় রাতের নাচের স্পেশ্যাল আইটেম পাঞ্চি শাড়ি ও পাঞ্চি ধুতি সঙ্গে মাথায় বাঁধার সুন্দর একটি কাপড় কেনা হল, সুদূর উড়িষ্যা থেকে আগত সাঁওতাল তাঁত কাপড় নির্মাতাদের কাছ থেকে, পুরো কাপড়গুলো কিন্তু ঘরের তাঁতে তৈরি। রাতে তো নাচতেই হবে, আদিবাসীদের নাচের ছন্দে পা মেলান- কত যুগের লালিত স্বপ্ন আজ পূরণ হতে চলেছে ।

এই জাহেরআয়ু থানেই আবার পূর্বপুরুষ দেবতা হারং বোঙ্গার থান অবস্থিত। সন্ধ্যা অবধি পুরোহিত বা নায়ক- বীরেন সরেন দেবতাদের থানেই ছিলেন। তারপর আবার ধামসা মাদল বাজিয়ে উনি ফিরে এলেন গ্রামের প্রতিটি ঘরে। সঙ্গে ঠাকুরের পুজোর জলপূর্ণ একটি ঘড়া এবং যুদ্ধ সাজে সজ্জিত ছেলেপুলের দল। আরো ছিলেন সেই সব ভক্তরা, যাঁদের উপরে দেবতার ভর হয়েছিল। এই উপলক্ষে, গ্রামের প্রতিটি ঘরের সামনে সোনা রঙের কাঁসার ঘড়ায় জল, কাঁসার বাটিতে তেল এবং একটি করে পিঁড়ি রাখা ছিল।
প্রতিটি বাড়ি থেকে দুটি মেয়ে বেরিয়ে, নায়েক এবং অন্যদেরও পা , জলে ধুইয়ে দিয়ে, তেল মাখিয়ে দেয় এবং সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। এভাবেই রাত বারোটা বেজে যায়।
বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।



বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।


বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।

সাঁওতালদের উৎসব আর নাচ গান হবেনা, তাও আবার হয় নাকি ! রাত ২ টো থেকে শুরু হল নাচ গানের এক অসাধারণ অনুষ্ঠান। সারা জীবনেও এই দিনগুলি ভোলা যাবেনা। এখন সকাল সাড়ে ছটা, অনুষ্ঠান এখনও চলছে।

 তৃতীয় দিন,অর্থাৎ আজকে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে জল খেলা, অর্থাৎ রং ছাড়া দোল খেলা ধরা যায়। চলবে শুনলাম বিকাল অবধি।  সময়ের অভাবে সেই অনুষ্ঠানে থাকা হল না। 

বাঁশপাহাড়ি গ্রামে গিয়ে এঁদের আচার আচরণের বিষয়ে আরো অনেক কিছু জানলাম।
সাঁওতালি ভাষায় দেবতাকে বংগা নামে ডাকা হয়। এঁদের জীবনেও বারো মাসে তের পার্বন।সহরাই, দাসাই,বাহা, বাহা- মা: মড়ে, সাকরাত, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এঁদের জীবনে বিভিন্ন উৎসব পালন জুড়ে আছে।

আদিবাসী সাঁওতাল সমাজের একটি অন্যতম পালা পার্বন ছিল শীষ বা বীজ বপনের পুজো। অনেকে এই উৎসবকে হারিয়ার সাম বা ধান বপনের উৎসব বলেন। জ্যৈষ্ঠ মাসে কৃষি জমিকে পুজো করে বীজ বপন করা হয়। সাঁওতালদের বিশ্বাস এতে কৃষি দেবী খুশি হয়ে ভালো ধান এবং ফসল দান করেন।
সাঁওতালদের দেবতা বঙ্গা আমরা অনেকেই জানি। সূর্যদেব বা সিং বোঙ্গার পুজোয় মুরগী বলির প্রচলন আছে । আবার মেরম বোঙ্গার পুজোয় ছাগ বলির প্রচলন। অর্থাৎ অস্ট্রিক সভ্যতার অন্যতম অবদান আজকের  হিন্দু ধর্মের বলি প্রথার প্রচলনের ।
সাঁওতাল সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ পরব  বাঁদনা বা সহরায় পরব। যদিও পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জায়গায় কালিপুজোর দিন থেকে পরবর্তী পূর্ণিমা অবধি সহরায় উৎসব পালন করা হয়, কিন্তু সাঁওতাল পরগনা, ছোট নাগপুর মালভূমির এক অংশে এবং রাঢ়বঙ্গের কিছু জায়গাতেও এটি পৌষ মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হয়ে পৌষ সংক্রান্তির আগে শেষ হয়।'ম৺ড়েসিঞ  ম৺ড়ে  ঞিদা' বা পাঁচ দিন পাঁচ রাতের অনুষ্ঠান হচ্ছে বাঁদনা পরব। নাচ গান আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে ভাই- বোন- জামাতা-বন্ধুদের মিলন উৎসব যেমন পালন করা হয়, তেমনি ঘর পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে গৃহপালিত পশুর যত্ন নেওয়া,সেগুলিকে চান করিয়ে, গরু মোষের শিঙে তেল সিঁদূর লাগিয়ে ধানের শীষের মুকুট পড়ানো হয়। গোয়াল ঘরে সারারাত ধরে প্রদীপ জ্বলে এবং বাঁশের বোনা নতুন কুলোয় ধান, দূর্বা, আতপ চাল, সিঁদুর এবং একটি জ্বলন্ত প্রদীপ দিয়ে গৃহপালিত পশুগুলির উদ্দেশে যে অনুষ্ঠান হয়, তাকে চুমাড়া বলে। এ ছাড়াও ছেলেরা গোয়াল ঘরের দরজার পাশে চাষের লাঙ্গল ও জোয়াল জলে ধুয়ে রাখে। মেয়েরা আলপনা দেয়। এরপরে হয় গোয়ালপুজো। বিবাহিত কন্যারা সপরিবারে এই কটা দিন পিতৃগৃহেই থাকে। যেন মা উমা আসেন বাপের বাড়িতে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি হয় গরু খেলানো উৎসব বা  খুঁন্ট( খুঁটা)। এমনি করে হাসি কান্নায় দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন কখন পেরিয়ে যায়। মেয়ে আবার চোখের জলে ফিরে চলে শ্বশুর বাড়িতে।

বাঁদনা পরব, করম পরব, ভাদু, টুসু, ছৌ, দিসম সেন্দ্রা, সহরায়, বাহা, বাহা-মা মড়ে পুরো আদি মানভূম জেলা এবং ছোটনাগপুর মালভূমিতে কত না উৎসব বা পরব। এর সঙ্গে আছে ঝুমুর গান ও নাচ।  
এসব নিয়েই সুরভিত হচ্ছে বঙ্গ সংস্কৃতি।

সাঁওতালদের একটি গান দিয়ে লেখা শেষ করছি-

"দেলায়া বিরিদপে দেলায়া তিঞূন পে,

জানাম দিশম লৌগিৎতে হো,

দেলায়া পায়ার:ক' তাবোন পে।"

ওঠো, জাগো, চলো জন্মভূমির জন্য এগিয়ে চলো।

এতো অনেকটা সেই বিবেকানন্দের অতি প্রিয় কঠোপনিষদের বাণীর মতন লাগছে না:- 

"উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।"

বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।









তথ্যসূত্র:-
১) আবাদভূমি, তৃতীয় বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৬ - এপ্রিল ২০১৭।
২)সুহৃদকুমার ভৌমিক । আর্য্ রহস্য। মনফকিরা।
৩) আদিবাসী সমাজ ও পালপার্বন : ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে।লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। 
৪) বাংলার জনজাতি, প্রদ্যোত ঘোষ। পুস্তকবিপনি।
৫) বাংলার সংস্কৃতি: লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়। পালযুগ,গুপ্তযুগ, সেনযুগ, থেকে অদ্যাবধি। নারায়ণ সামাট। দেশ প্রকাশন।
৬)সাঁওতাল সমাজ সংস্কৃতি ও সংগ্রাম, শিবেন্দুশেখর মিশ্র। লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গ সরকার।



Tuesday, June 23, 2020

বনকাটি - আ জুয়েল ইন দ্যা ক্রাউন।

বনকাটি - আ জুয়েল ইন দ্যা ক্রাউন।

বনকাটির কালীতলার দুটি আটচালা ও তিনটি দেউল, ছবি-লেখক।
পশ্চিম বর্ধমান জেলার কাঁকসা ব্লকের অন্তর্ভুক্ত, প্রায় অজয় নদের ধারে একটি ছোট্ট গ্রাম বনকাটি। কাঁকসা নামটি সম্ভবত এসেছে জনৈক রাজা কঙ্ক সেন বা কনক সেন থেকে। আর বন কেটে বসত বলে নাম তার বনকাটি। বনকাটির এই অংশের প্রাচীন নাম অবশ্য সেন-পাহাড়ি, অতীতে কিন্তু দু দুটি সেন রাজবংশের নাম এই স্থানের সঙ্গে যুক্ত ছিল- ১) বাংলার সেন রাজাদের  বিশেষ করে রাজা লক্ষণ সেনের সময় থেকেই নাকি সেনপাহাড়ি নামকরণ , ২) অনেক পরে বর্ধমানের রাজা চিত্রসেন এই অঞ্চলের কিছু সংস্কার সাধন করেন।

পশ্চিবঙ্গের বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া এবং অজয় নদের গা ঘেঁষা বর্ধমান জেলার মাটির রং লাল। লাল রঙের ল্যাটেরাইট গোত্রের  মাটি পুড়িয়েই তৈরি হত টেরাকোটার মূর্তি ও প্লেট। এই অঞ্চলগুলোতে প্রচুর টেরাকোটার কাজ সমৃদ্ধ সুন্দর মন্দির আছে যা বাঙালি জাতির সহজাত অজ্ঞতা এবং আপন সংস্কৃতির ওপর উন্নাসিক ব্যাবহারে হারিয়ে যাচ্ছে। ১৭ ও ১৮ শতকে এই সব পোড়ামাটির মন্দির তৎকালীন কুম্ভকার ও কর্মকাররা কি অসম্ভব দক্ষতায় তৈরি করেছিলেন, তা এসব প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত মন্দিরের  ইঁটের এবং পোড়ামাটির টালির কাজ দেখলে বোঝা যায়। কি নেই এসব মন্দির ভাস্কর্যে ? পুরান থেকে আধুনিক ইংরেজ রাজত্ব, নৌবিহার থেকে শিকার, যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে দৈনন্দিন জীবন সংগ্রাম, সবকিছুই দেখা যায় এইসব টেরাকোটা প্যানেলের মধ্যে। বলা যায় সেযুগের সমাজ জীবনের জীবন্ত দলিল এই সব পোড়ামাটির কাজগুলি।

টেরাকোটার মহিষমর্দিনী ফলক বনকাটি, ছবি- লেখক
বন কাটির রথের মেলা ২০১৯, ছবি লেখক ।
রথের মেলায় এসেছি এই গ্রামের প্রাক্তন জমিদার এবং ইংরেজ আমলে গালার ব্যাবসা করে তৎকালিন সর্বাধিক ধনী ব্যক্তি রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্টিত পঞ্চরত্ন গোপালেশ্বর শিব মন্দির এবং উনার বাসস্থান দেখতে। বনকাটি তে থিতু হবার আগে ইনারা ছিলেন নিকটবর্তী বসুধা গ্রামের পূজারী ব্রাহ্মণ।
বন কাটির রথের মেলা ২০১৯, ছবি লেখক ।
বন কাটির রথের মেলা ২০১৯, ছবি লেখক ।
বন কাটির রথের মেলা ২০১৯, ছবি লেখক ।
রত্ন বলে রত্ন ! এই মন্দিরটি এবং মন্দিরের পাশেই রাখা একটি পিতলের অসম্ভব সুন্দর রথ দেখে তো স্পেল বাউন্ড । এ কি ঐশ্বর্য দেখছি চর্ম চক্ষে ! অবিশ্বাস্য।
মন্দিরের গায়ের ফলকের লেখা দেখে জানা গেল যে এই পঞ্চরত্ন মন্দিরটি নির্মিত ১৭৫৪ শকাব্দে বা ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ আজ থেকে ১৮৮  বছর আগে।

বন কাটির পঞ্চরত্ন মন্দির।
কাল স্রোতে ভেসে যায় জীবন- যৌবন- ধন-মান। আজ রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিশাল অট্টালিকা বার্ধক্যে জরাজীর্ণ, ছাদ খসে পড়েছে। কোনোরকমে অট্টালিকার গুটি কয়েক দেওয়াল ও বিশাল বিশাল স্তম্ভ, বটগাছের ঝুঁড়ি আঁকড়ে বাঁচতে চাইছে। সামনের পঞ্চরত্ন মন্দিরের পিছনেই জমিদারের ভাঙা অট্টালিকা। খোলা জানালার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা হাওয়া এক আধিভৌতিক স্বর বয়ে আনছে। মেহের আলীর মতন যেন বলছে-তফাৎ যাও, সব ঝুট হায় !

রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিশাল অট্টালিকা। ছবি-লেখক।
অবশ্য পঞ্চরত্ন মন্দিরটি সেই তুলনায় কম ক্ষয়প্রাপ্ত, মন্দিরের মধ্যে আছে এক বৃহৎ শিবলিঙ্গ । যদিও এর দেওয়ালেরও অনেক টেরাকোটা টালির ফলক খসে পড়েছে বা ভেঙে গেছে। তবু এখনও যা আছে, তাতেই চোখ ঝলসে যায়।

দশমহাবিদ্যার প্যানেল। ছবি- লেখক

রাজা রামের রাজসভা। ছবি- লেখক
প্রথমেই চোখ যায় দরজার খিলানের উপরে শুক সারী, দুই দিকে দুই রথ, ডাইনে পাঁচ চূড়ার, বাঁয়ে তিন চূড়ার। রথের ওপরের প্যানেলেই আছে রাজা রামের রাজসভা।রামের মাথায় রাজছত্র, পাশে সীতা দেবী।বিভিন্ন সভাসদ এবং অনুচরদের মধ্যে রাম ভক্ত বানরেরাও আছে।
দেবী দুর্গার টেরাকোটার মূর্তিটি দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল।অনেক ওপরে রাজা দশানন অবস্থান করছেন।মন্দিরের ভূমিসংলগ্ন টেরাকোটার প্যানেল গুলি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য এই কারণেই যে-এখানে দেবীর দশমহাবিদ্যার অনেক রূপ স্থান পেয়েছে।

ইংরেজ যুগের টমটম গাড়ি, ছবি- লেখক।

নৌকা বিলাস, টেরাকোটার ফলক, বনকাটি।
এই পঞ্চরত্ন মন্দিরে, আরো কত যে টেরাকোটার মূর্তি আছে তা গুনে শেষ করা যাবে না।রামায়ণ, মহাভারত, পুরান থেকে ইংরেজ আমলের টমটম গাড়ি, নৌকাবিলাস -কোন কিছু বাদ নেই। 
 বনকাটি গ্রামের জমিদার মুখোপাধ্যায় পরিবারের টেরাকোটার পঞ্চরত্ন মন্দিরের পাশেই একটি টিনের চালার নিচে রাখা এক বিস্ময়কর পিতলের রথের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ।এত বড় সম্পূর্ণ পিতল নির্মিত অসাধারণ শৈল্পিক ও দৃষ্টিনন্দন রথ সচরাচর দেখা যায় না।চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত কি অপূর্ব এই সম্পদটি।

২০১৯ এর রথের দিন, পিতলের রথের সাজ।

২০১৯ এর রথের দিন, পিতলের রথের সাজ।
পিতলের রথের কাজ, নর-সিংহ অবতার।
গাজনের বাজনা বাজা, বনকাটি পিতলের রথ।

বড়লোকের গিন্নি, ছবি- লেখক
বাংলা ১২৪১ সালে বনকাঠি গ্রামের জমিদার মুখোপাধ্যায় পরিবারের জনৈক সদস্য শশী ভূষণ মুখোপাধ্যায় , উনাদের পারিবারিক পঞ্চরত্ন শিব মন্দিরের অনুকরণে এই পাঁচ চূড়ার পিতলের রথ তৈরি শুরু করেন।যার নির্মাণ শেষ হয় ১২৪২ সালে। ঠাকুরও আছেন পিতলের তৈরি, আছে সোনা রুপার গহনা, মুকুট ইত্যাদি।একটি রথযাত্রা কমিটি রথের দিনের সমস্ত কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করে। জানা গেল যে এই রথ নির্মাণের জন্য সেই সময় উড়িষ্যা থেকে শিল্পীরা এসেছিলেন।

 বাঙালিরা এসব জায়গায় না এলে কি হবে, কোন অতীতে নন্দলাল বোস এসেছিলেন কলা ভবনের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে এখানে। বিশ্ব বিখ্যাত ড্রাই পয়েন্ট এচিং শিল্পী এবং গভর্মেন্ট স্কুল অফ আর্টস এর প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ শ্রদ্ধেয় মুকুল দে মহাশয়(১৮৯৫-১৯৮৯) প্রায় সত্তর বছর আগে বনকাঠি গ্রামে এসেছিলেন এবং এখানকার পোড়ামাটির কাজ এবং পিতলের রথ দেখে মুগ্ধ হয়ে হয়েছিলেন।
কিন্তু উপেক্ষিত বনকাঠি লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে। জানিনা বাঙালিরা নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে এত উদাসিন কেন !

রথের দুই দিকেই মহাবীর গরুড়ের দুটি মূর্তি। রথের চার দেওয়াল এ যে কত অলংকরণ- গুনে শেষ করা যায়না। পুরান, মহাভারতের কথা, রামায়ণের চরিত্র এসব তো আছেই।এছাড়াও সে যুগের সমাজের অনেক দৃশ্যাঙ্কন আছে।যেমন সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলার ছবি আছে, তেমনি আছে গরীব ঘরের মেয়ের মাদারির খেলা দেখানো বা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে ফেরিউলি ।আবার ধনবান শ্রেষ্ঠীও আছেন এই ছবিতে।এমন কি বাংলার এই অঞ্চলে মন্দির গাত্রে বা রথে যে ছবি সচরাচর দেখা যায় না, সেরকম দুটি মৈথুন মূর্তিও এর গায়ে অঙ্কিত।
সুতরাং এটি শুধুমাত্র কোনো একটি রথ নয়,  যেন সে যুগের ভারতীয় সভ্যতা ও ভারতাত্মার এক চমৎকার ডকুমেন্টেশন।


এরকম পিতলের রথের উদাহরণ খুব বেশী জানা নেই।শ্রদ্ধেয় তারাপদ সাঁতরা মহাশয় ১৩৭৭ বঙ্গাব্দের 'সাহিত্য পত্র' পত্রিকায় বর্ষা সংকলন সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গে সর্বমোট ৪১টি পিতলের রথের সন্ধান পেয়েছেন, যার মধ্যে বনকাটির রথই প্রাচীনতম।শ্রী অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ' দেখা হয় নাই' গ্রন্থের ১৪৫ নম্বর পৃষ্ঠে মন্তব্য করেছেন " বনকাটির রথটি আকারে মাঝারি, উচ্চতা অনধিক ১৫ ফুট, একতলার দৈর্ঘ্য প্রস্ত ৬'৫", দোতলার ৪'৫"। কিন্তু খোদাই কাজের প্রাচুর্য এবং সাবলীলতায় এটিই যে এ দলে সর্বশ্রেষ্ঠ তাতে সন্দেহ মাত্র নেই।"
সুতরাং রূপের গরবে গরবিনি বলতে বঙ্গদেশে এই বনকাঠির রথই বোঝায়। 
রথের মেলায় বড় প্রাপ্তি এখানকার মাস্টারমশাই প্রণব ভট্টাচার্যের সাহচর্য এবং একটি চমৎকার গ্রামীন মেলার ফ্লেভার। পাঁপড় ভাজা , আলুর চপ, ঘুগনি বা গ্রামীণ মিষ্টি তো আছেই। বিশাল বিশাল খাঁজা কাঁঠাল বিক্রি এই মেলার অন্যতম বিশেষত্ব। 

কি অফুরন্ত রত্ন ভান্ডার লুকিয়ে আছে এই বিস্মৃত প্রায় বনকাটি গ্রামের আনাচে কানাচে তা প্রত্যক্ষ করতে হলে একদিন ঘুরে যান এখানে।জাতীয় সড়ক ২ - ধরে এসে, দার্জিলিং মোড় থেকে ডানদিকে ঘুরে পানাগর-মোড়গ্রাম হাইওয়ে ধরুন, নেমে যান ইলামবাজার এর কিছু আগে এগারো মাইল স্টপেজে।
শান্তিনিকেতন থেকে এলে, ইলামবাজার পার করে এগারো মাইলে নামুন।সেখান থেকে খুব কাছেই অযোধ্যা এবং বনকাটি গ্রাম। মোড় থেকে রিকশা বা ভ্যান পাবেন।
আটচালা মন্দির, কালীতলা, বনকাটি ।
ভগ্ন দেউল , বনকাটি ।

আরেকটা পথ হচ্ছে জয়দেব ঘাট এবং অজয় নদ পেরিয়ে বাঁদিকে ঘুরে গৌরাঙ্গপুর- ইছাই ঘোষের দেউল হয়ে বনকাটি যাওয়া।আসানসোল/ দুর্গাপুর থেকে এলে মুচিপাড়ায়, কল্পনা ইন এর পাশে জয়দেব যাবার রাস্তা ধরে, গৌরাঙ্গপুর /ইছাই ঘোষের দেউল হয়ে যেতে পারেন। জয়দেব যাবার রাস্তা ধরলে অধিক প্রাপ্তি হবে ইছাই ঘোষের দেউল দর্শন, উপরন্তু দুর্গাপুর টোল প্লাজার যানজট এবং অসম্ভব বেশি সড়ক দর্শনী বাদ যাবে।
কালীতলা, বনকাটি ।
গাছ গাছালিতে ঢাকা পায়ে চলার পথ দিয়ে চলেছি বনকাটি দর্শনে।প্রথম স্থানটির নাম কালিতলা।রাস্তায় পড়লো ঘন জঙ্গলের মধ্যে স্থানীয় মুখোপাধ্যায় বংশের প্রতিষ্টিত একটি পরিত্যক্ত আটচালা।পরিত্যক্ত হলেও এখনও বেশ ভালো অবস্থা তেই আছে সেটি। সেখান থেকে সামান্য কিছুদুরেই কালীতলা। নাম থেকেই বুঝতে পারছেন, এখানে একটি কালী মন্দির আছে। এই মন্দিরে সারা গ্রামের লোক পুজো দেন। প্রাচীন কালের বলির পাথরের বিশাল হাঁড়িকাঠটি দেখে ভয় লাগে। কালী মন্দিরের প্রতিষ্টাতা জনৈক লক্ষ্মীকান্ত রায়।

কালীতলার একদিকে তিনটি রেখ দেউল এবং এর উল্টোদিকে দুটি প্রাচীন আটচালার মন্দির অবস্থিত। উত্তরমুখো দুটি আটচালার মধ্যে বাঁ দিকের প্রথম মন্দিরটির দরজার খিলানের উপরে চমৎকার দুর্গা প্যানেল,এটির নির্মাণ ১৭০৪ শকাব্দে(বা এর সঙ্গে ৭৮ যোগ করলে হবে ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে) এবং ডানদিকের অন্য মন্দিরটির  নির্মাণ ও ১৭০৪ শকাব্দে(১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে) । এই মন্দিরের দরজার খিলানের উপরে চমৎকার গনেশ মূর্তি দেখা যায়।
রেখা দেউল গুলি ১৭৫৬ শকাব্দে( বা ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে) নির্মিত অর্থাৎ ১৮৫ বছরের প্রাচীন।এখানে প্রথম মন্দিরটির দরজার উপরের প্যানেলে মা কালী বিদ্যমান। পরের টির মাথার উপরে মা দুর্গা এবং তৃতীয়  টির  ওপরে বিদ্যমান মা ত্রিপুরাসুন্দরী ।


রথের দিন- ২০১৯, বনকাটি ।

আরো দুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস প্রাপ্ত দেউল চোখে পড়লো। মাথা অবধি ঢাকা আগাছায় । জানা গেল এই ভাঙা দেউলের মধ্যে নাকি বেশ কিছু বিষধর সাপ বাস করে, তাই কেউ ভয়ে এখানে যায়না। কোন এক মহিলা নাকি তাঁর প্রয়াত স্বামীর উদ্দেশ্যে এই জোড়া দেউল নির্মাণ করেন। এই জোড়া দেউলের পিছনেই আছে সমতল ছাদের পরিত্যক্ত বিষ্ণু মন্দির।
রথের দিনে আলাপ হয়েছিল, এই মন্দির গুলি যাঁরা তৈরি করেছিলেন সেই চট্টোপাধ্যায় বংশের বর্তমান উত্তরপুরুষ শ্রী অনিল কুমার রায়ের সঙ্গে। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে ধরা হয় জনৈক তান্ত্রিক সাধক মহেশ্বরপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় কে ।
এখন উনারা রায় পদবি ব্যাবহার করেন।এক বিশাল কাঁসার রেকাবি বের করে উনি দেখিয়েছিলেন , এই রেকাবির পিছনে উনাদের বংশলতিকা লেখা আছে।ব্যাস, এই রেকাবিটাই যা এখনও বেঁচে আছে উনাদের কাছে, বাকি সমস্ত মন্দিরের বাসন কোসন ডাকাতেরা নিয়ে গেছে । অতি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।
বনকাটি বেড়াতে এলে পাশের অযোধ্যা গ্রামের কামার পাড়ার চারটি রেখদেউল পারলে দর্শন করবেন। স্থানীয় কর্মকার পরিবার এই মন্দিরগুলো নির্মাণ করেছিলেন। আর আছে ময়রাপাড়ার পঞ্চরত্ন শিবমন্দিরের গায়ে মোহন্ত-এলোকেশীর ঘটনার টেরাকোটার ট্যাবলেট।
"তেপান্তরের পাথার পেরোই রূপকথার,
পথ ভুলে যাই দূর পারে সেই চুপকথার।"
আজ্ঞে হ্যাঁ ! বনকাটির একদম কাছেই আছে সে এক তেপান্তরের রূপকথার গ্রাম - গ্রামটির নাম সাতকাহানিয়া। জানেন কিনা জানিনা, পশ্চিম বাংলায় এটিই একমাত্র নাট্যগ্রাম। এখানকার  মাস্টার মশাই প্রণব ভট্টাচার্য এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্র কল্লোল এর হাত ধরে স্থানীয় চাষী, বাউড়ি, বাগদি ইত্যাদি সম্প্রদায়ের  মানুষদের নিয়ে ১৯৯৪ সালে তৈরি হয় নাট্যগ্রাম তেপান্তর।

এখানে সকালে যাকে জমিতে চাষ করতে অথবা পুকুরে জাল ফেলতে দেখবেন, সন্ধ্যায় তাঁকেই  দেখবেন থিয়েটারে অভিনয় করতে। এমন অসাধারণ, অভূতপূর্ব, অভিনব সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, বাংলার আর কোথাও হয় কিনা জানিনা।

 গ্রামীন মানুষেরাই এই নাট্যগ্রামের প্রাণ। তাঁদের মানসিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উত্তরণের সোপান এই নাট্যগ্রাম।
সারা পৃথিবী থেকে ডাকসাঁইটে শিল্পী ও নাট্য পরিচালকেরা আসেন এখানে অনুষ্ঠান করতে, নিয়মিত সংগীত ও নাটকের ওয়ার্কশপ হয়।
সারা বছর ধরেই এখানে লোকসংস্কৃতি প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে কর্মকান্ড চলে। দোলের সময়  হয় ৩ দিন ব্যাপি বসন্ত উৎসব।

 সে একটি দেখবার মতন ব্যাপার।  হস্ত শিল্পের দোকান, পুরুলিয়ার ছৌ, ওডিসি নৃত্য, উড়িষ্যার গুটি পোয়া নাচ, ধ্রুপদী নৃত্য, লোক নৃত্য, ঝুমুর গান, বাউল গান, আরো কত লোকগান, এলাকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান এবং সর্বোপরি কল্লোলের নাটকের গ্ৰুপ "এবং আমরা" নাট্যদলের নাটক এবং শেষ অনুষ্ঠানে হয় আতশবাজির প্রদর্শন। সারা বাংলা ও বিদেশ থেকে এই অনুষ্ঠানে বহু বিশিষ্ট মানুষেরা যোগদান করেন। স্থানীয় মানুষের ঢল নামে মেলাতে। 

বনকাটি আসবেন আর গড়জঙ্গলের শ্যামরূপা চন্ডী এবং ইছাই ঘোষের দেউল দেখবেন না, সে আবার হয় নাকি !



শাল, শিরীষ, অর্জুন আরো কত নাম না জানা গাছগাছালিতে ঢাকা , লাল মোরামের চমৎকার  পথ দিয়ে চলেছি গড় জঙ্গল। ঝাঁকে ঝাঁকে ফিঙে, বুলবুলি আর গাছের কোটরে উঁকি দিচ্ছে টিয়ার টুকটুকে সবুজ ছানা।কোনো কোনো জায়গায় ভর দুপুরেও সূর্যরশ্মির প্রবেশ নিষেধ। বেশ একটা রোমাঞ্চকর আলো আঁধারীর পরিবেশে পৌঁছলাম সামান্য দূরের মেধা মুনির পৌরাণিক কাহিনী আশ্রিত আশ্রমে। সাধুবাবারা রক্তবর্ণের আভরণ ও টিকা নিয়ে ব্যাস্ত পুজোর আয়োজনে।বর্তমান মন্দিরের পেছনেই আদি মেধা মুনির আশ্রমের খণ্ডহর।সেখান থেকে সামান্য দূরেই এক অতি প্রাচীন ঢিবি। বোর্ডে লেখা আছে এখানেই রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য  মার্কণ্ডেও পুরান অনুসারে প্রথম দুর্গা পুজো করেন। অবশ্য এর সত্যাসত্য নিয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়, কারণ এটি বিশ্বাস ও ভক্তি দিয়ে, পুরান কথা অনুসারে , মেধাশ্রমে সাধুদের অন্তরের বিশ্বাস। এই বিশ্বাস ও লোককথার মধ্যে ইতিহাসকে খুঁজতে না যাওয়াই ভালো।
গড় জঙ্গলের দুর্গাপুজোর একটি লোকমুখে প্রচলিত আখ্যান যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে নাকি সারা পাহাড় জঙ্গল কাঁপিয়ে পর পর তিনবার তোপ ধ্বনির আওয়াজ শুনতে পাওয়া যেত। সেই দৈবীক আওয়াজ শুনেই নাকি পশুবলি শুরু হত।

শ্যামরুপা চণ্ডী , ছবি- লেখক।
মেধাশ্রম থেকে গেলাম মহামান্ডলিক  ইছাই ঘোষের আরাধ্য দেবী শ্যামারুপা চণ্ডী মন্দিরে।জনশ্রুতি রাজা লক্ষণ সেন-ও এই মায়ের মন্দির নিয়মিত পুজো দিতে আসতেন।পূজারীর কথা অনুসারে, অতীতের জীর্ণ মন্দিরের উপর এই নতুন মন্দিরটি নির্মাণ হয়েছে। দুর্গা এবং কালী পূজাতে অসংখ্য ভক্ত সমাগম হয়।

একদা এই মন্দিরটি পুনর্নিমান করেছিলেন, বর্ধমানের রাজা। তখন রাজকোষ থেকেই পুজো ও পুরোহিতের দক্ষিণার ব্যবস্থা ছিল। পরে এই মন্দিরটির দায়ভার, বর্ধমানের রাজাদের কাছ থেকে হেতমপুর রাজাদের হাতে ন্যস্ত হয়। হেতমপুর রাজ, গড়জঙ্গলের, বিষ্ণুপুর গ্রামের জনৈক হরিপদ রায়কে দেবোত্তর জমিসহ মন্দিরের পুরোহিত নিয়োগ করেন। উনার বংশধরেরাই এখনও এই মন্দিরের পুজোর পৌরোহিত্য করছেন। তবে বর্তমান মন্দিরটি অর্বাচীন। পুরানো মন্দিরের স্থ্যানেই, এই মন্দির নির্মাণ হয়েছে ১৯৬০ সালে। নির্মাতা ডি এস পির প্রাক্তন উচ্চ আধিকারিক শ্রী করুণা কেতন রায় মহাশয়। বর্তমানে মন্দির গাত্রে প্রোথিত শ্বেত পাথরের দশ ভুজা মূর্তিটি কিন্তু আদি মূর্তি নয়। শোনা যায় ইছাই ঘোষের পূজিত আদি মূর্তিটি স্বর্ণ নির্মিত ছিল। ইছাই ঘোষের মানস কন্যা( পালিত ?)র বিয়ে হয়েছিল শিখরভূম বা পাঞ্চেত রাজ কল্যাণ শেখরের সঙ্গে।  ইছাই ঘোষের মৃত্যুর পরে, কে আর দেবীর পুজো করবে এই আশঙ্কা থেকে নাকি মন্দিরের পুরোহিত মায়ের মূর্তিটি স্থানীয় দীপ সায়রের জলে ভাসিয়ে দেন। আরেকটি মত হচ্ছে, ইছাই ঘোষের মেয়ে জামাই দেবী মূর্তিটি নিয়ে যাবার সময় বরাকর নদীর বানে মূর্তিটি ভেসে যায়। পরে দেবীর স্বপ্নাদেশ অনুসারে রাজা কল্যাণ শেখর মায়ের শিলারূপী মন্দির নির্মাণ করেন। রাজার নামে সেই স্থানের নাম হয় কল্যানেশ্বরী এবং মন্দিরের নাম হয় মায়ের থান বা মাইথন।

তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে গড়জঙ্গলের নাম সেন পাহাড়ি কি করে হয় ? বলা হয় বখতিয়ার খিলজীর নদীয়া আক্রমণের সময়, জ্যোতিষীর পরামর্শে লক্ষণ সেন কোন রকম যুদ্ধ না করে বাড়ির খিরকির দরজা দিয়ে পালিয়ে এসে গড় জংগলে কিছুদিন আত্মগোপন করে ছিলেন। তাই অনেকেই এই জায়গাটিকে সেন পাহাড়ি বলে উল্লেখ করেন। 

 ইছাই ঘোষের মা চণ্ডী বা মা ভবানীর, শ্যামরুপা চন্ডীর নামকরণ নিয়ে অনেক কাহিনী শোনা যায় ।
 কেউ কেউ বলেন তিনি দেবী কালিকা, কেউ বলেন শ্রী কৃষ্ণের রাধিকা। আবার অনেকে বলেন দেবী হচ্ছেন সুক্ষোশ্বরী ,শ্যামলা নামক এক আদিম জনজাতির পূজিত দেবী। তবে পুরোহিত এবং ভক্তদের মুখে প্রচলিত এক জনপ্রিয় কাহিনী আপনাদের জানাচ্ছি । এই নামকরণের সঙ্গে নাকি যুক্ত আছে অজয়ের পার্শ্ববর্তী স্থান জয়দেবের- কবি জয়দেব, রাজা লক্ষ্মণ সেন এবং এক তন্ত্র সাধক কাপালিকের কাহিনী।
রাজা লক্ষ্মণ সেন তখন সেন পাহাড়িতে লুকিয়ে আছেন। উনার সভাকবি জয়দেব আছেন উনার সঙ্গে। আর ইছাই ঘোষের মন্দিরে এক দুরাচারী তান্ত্রিক আশ্রয় নিয়েছেন। মাঝে মধ্যে নাকি সেই তান্ত্রিক মায়ের পুজোর নামে নরবলি দেন।
জয়দেব ও কাপালিকের মধ্যে নরবলি নিয়ে প্রচন্ড কলহ হয়। দুজনেই লক্ষণ সেনের কাছে গিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে নালিশ করেন। কার পুজোতে দেবী খুশি হবেন, সেই নিয়ে দুজনই প্রমান দেবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। কাপালিকের আকুল আহ্বান সত্ত্বেও পাষান মূর্তির কোন হেলদোল হোল না। কিন্তু জয়দেবের মধুর সংগীতে নাকি দেবীর শিলা মূর্তির মধ্যে কৃষ্ণ ও দেবী চন্ডিকার( লোকমুখে রুপা , দুর্গার এক রূপ) মূর্তি ফুটে ওঠে। কাপালিক পরাজয় স্বীকার করে দেশান্তরী হয়ে যান। লোকমুখে দেবীর নাম হয় শ্যামরুপা চণ্ডী।

সেখান থেকে চললাম গোপরাজ ইছাই ঘোষের দেউল-এ। ধর্মমঙ্গল কাব্যেও ইছাই ঘোষের উল্লেখ আছে। ইছাই ছিলেন গোয়ালা, ছিলেন স্বাধীনচেতা, বিদ্রোহী।নিজের সৈন্যদল তৈরি করেছিলেন- বাউরি, মুচি, হাঁড়ি, বাগদি, ডোম ইত্যাদি সমাজের দুর্বলতম মানুষদের নিয়ে।এদের মনে এখনো বীর ইছাই ঘোষের স্মৃতি জাগরুক।ইতিহাস বলে পাল রাজা মহিপালের সময় রাজ্যের ভাঙ্গনের সূচনা হয়।অনেক সামন্ত রাজারা বিদ্রোহ করেন, যার মধ্যে ইছাই ঘোষ অন্যতম। স্থানীয় রাজা কর্নসেনকে পরাজিত করে, বর্ধমান জেলার এক বিস্তীর্ণ অংশে গড়ে তোলেন গোপভূমি বা ঢেকুরগড়।
ইছাই ঘোষের মৃত্যুর পরে, সম্ভবত পরবর্তী কোন গোপ রাজা, তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে, এই অতি চমৎকার দেবালয় বা দেউল টি তৈরি করেন সম্ভবত মাতা ভগবতীর উদ্দেশ্যে।
আবার অনেকের কাছে শুনেছি বর্ধমানের মহারানী বিষ্ণুকুমারী এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। আবার মন্দির নির্মাতা হিসাবে বর্ধমান রাজ চিত্র সেনের উল্লেখ ও পাওয়া যায়।

ইছাই ঘোষের দেউল, ছবি- লেখক ।
অনেক পরে  এই মন্দিরটির মধ্যে একটি সুবিশাল শিবলিঙ্গ , সম্ভবত কোন স্থানীয় জমিদার রেখে দেন, সেই থেকে  স্থানীয়রা একে শিব মন্দির বলেই গণ্য করে। অবশ্য জমিদার মহাশয় এটিকে শিব মন্দির ভেবে নেওয়ার পিছনে হয়ত কাজ করেছিল, এই দেউল এর মধ্যে কীর্তিমুখ মূর্তির উপস্থিতি। রাক্ষসের মতন দেখতে কীর্তিমুখ কিন্তু  শিব মন্দিরের বিশেষত্ব।স্কন্ধ পুরানে বলা হয়েছে, শিবের আদেশে জলন্ধর রাক্ষস নিজের শরীরকে নিজে গিলে ফেললে, শিব তার নাম নাম দেন- কীর্তিমুখ বা ফেস অফ গ্লোরি।

অনেক পুরাতাত্ত্বিকদের মতে এটি এগারোশ শতকে নির্মিত। তবে শ্রদ্ধেয় বিনয় ঘোষের মতে এটি ষোড়শ বা সপ্তদশ শতকে নির্মিত ।
দেখতে অনেকটা ওড়িশা শিখর মন্দিরের ধাঁচের।মন্দিরটিতে পাঁচটি ধাপ দেখা যায়।তাছাড়া, বিভিন্ন সময়ে সংযুক্তি বা রক্ষণাবেক্ষণের  কাজ হয়েছে বোঝা যায়- আলাদাভাবে বিভিন্ন রকম ইঁটের নমুনা দেখে। অসম্ভব সুন্দর নৃত্যরতা নর্তকী এবং কীর্তিমুখ মূর্তি, এই দেউল এর অন্যতম সেরা কাজ।
ইছাই ঘোষের দেউলের পাশে অজয়ের শোভা ।

সেখান থেকে বেড়িয়ে কিছুক্ষনের জন্য দাঁড়ালাম অজয়ের তীরে। চতুর্দিকে আদিগন্ত বিস্তৃত কাশবনের মধ্যে দিয়ে একফালি নদী তিরতির করে বয়ে চলেছে। আহা! কি হেরিলাম! জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না।


(প্রয়োজনীয় তথ্য-
কোথায় থাকবেন।- দুর্গাপুর, কলকাতা, শান্তিনিকেতন থেকে খুব সকালে গাড়ি নিয়ে এলে একদিনেই বনকাটি দেখে ফেরা যায়। আঞ্চলিক ইতিহাস জানতে মাস্টার মশাই প্রণব ভট্টাচার্যকে আগে থেকে ফোন করে রাখবেন- 9474375260.
সেক্ষেত্রে গাড়িতে অবশ্যই খাবার ও জল নিয়ে যাবেন।
যদি রাত্রি বাস করতে চান, তবে একমাত্র ও অতি চমৎকার স্থান Deul park, পিন ৭১৩১৫২। অজয় নদের ধারে এই স্থানটি নিজেই একটি চমৎকার দ্রষ্টব্য।পরিবেশ অতি মনোরম, কর্মচারীরা ভদ্র।প্রয়োজনীয় সবকিছুই পাবেন। উপরি পাওনা ইছাই ঘোষের দেউল দর্শন। নেটে বুকিং করতে পারেন। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ -9831555594.
আর উৎসব অনুষ্ঠানে বড় গ্ৰুপে  এলে সাতকাহানিয়া নাট্যগ্রামের অসাধারণ পরিবেশেও থাকতে পারেন। ফোন- কল্লোল ভট্টাচার্য, 9434646982.)

তথ্যসূত্র:- 
১) গৌড় কাহিনী, শ্রী শৈলেন্দ্র কুমার ঘোষ। ডি এম লাইব্রেরি, ৪২ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট, কলকাতা ৬ ।
২)পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, প্রথম খন্ড, বিনয় ঘোষ। প্রকাশ ভবন, কলিকাতা ৭০০০১২।
৩)মিথ পঞ্চদশ, মন্দিরের মিথ, মিথের মন্দির, কৌশিক দত্ত। পার্চমেন্ট।
৪) গড়ের মা, তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রাম-ডানজোনা, পোষ্ট:- রামপুর, থানা - মহাম্মদ বাজার, জেলা- বীরভূম, ৭৩১১২৭  ।।
৫) বাঙ্গালার ইতিহাস, প্রথম খন্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ। শ্রীরাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়  প্রণীত। মনোমোহন প্রকাশনী, কলেজ স্ট্রিট।
৬) INSCRIPTIONS OF BENGAL, NANI GOPAL MAJUMDAR, SANSKRIT PUSTAK BHANDAR. Bidhan Sarani, Kolkata.
৭) শ্রী নবারুণ মল্লিক, ক্ষেত্র-সমীক্ষক, দুমকা, ঝাড়খণ্ড।

Monday, June 22, 2020

অম্বুবাচী উৎসব কি এবং কেন ?

 অম্বুবাচী উৎসব কি  এবং কেন ?  

কামরূপ , কামাখ্যা মন্দির। ছবি-লেখক
" কিসের বার কিসের তিথি,  আষাঢ়ের সাত তারিখ অম্বাবতী" - আমাদের ছোটবেলায় মা- ঠাকুমার মুখে শোনা  এই কথাটি হয়ত এখনও  অনেকেরই মনে আছে।

  সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত অনেক পুজো, আর্চা, অনুষ্ঠান সম্মন্ধে বর্তমান প্রজন্ম প্রায় কিছুই জানেনা। অথচ আমরা প্রায় সবাই জানি যে, জাতিসংঘের নির্দেশনায় ,১৯৭০ সাল থেকে, প্রতি বছর ২২ শে এপ্রিল দিনটিকে সারা পৃথিবীতে ধরিত্রী দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে, আমরাও করছি । কিন্তু সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতীয়রা যে নিজেদের মতন করে ধরিত্রী দিবস পালন করে আসত, অম্বুবাচী বা অম্বাবতী বা অমাবতী নাম দিয়ে, অনেকেই তার কোন খোঁজও রাখেননা। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সম্মন্ধে আমরা বোধহয় উদাসীন।
এটা তো মানবেন যে, বেদ-পুরান সর্বত্রই বসুন্ধরার উল্লেখ করা হয়েছে, ধরিত্রী মাতা বলে। আর্যদের আগমনের অনেক আগে থেকেই অস্ট্রিক সভ্যতার মানুষেরা বিভিন্ন নামে ধরিত্রী মাতার পুজো করে এসেছে, এবং এখনও করছে। 

যেমন  ধরুন ওড়িশার কন্ধমাল জেলার কন্ধ আদিবাসীদের বিশ্বাস তাঁদের আদিমাতা হচ্ছেন ধরিত্রী দেবী বা 'দারনি'/টানা' পেনু এবং পিতা হচ্ছেন পর্বত দেবতা 'সারু পেনু'।

এঁদের সমাজের বিভিন্ন উৎসবের নামের সঙ্গে যুক্ত থাকে 'লাকা' শব্দটি।যেমন ফসল কাটার উৎসব 'সিসা লাকা', মহুয়া ফুলের উৎসব 'মারাঙ্গা লাকা'', আম খাবার উৎসব 'কেঁদু লাকা' ইত্যাদি। এই উৎসব কিন্তু আদতে পৃথিবী পুজো। ধরিত্রী মাতাকে  উৎসর্গ না করে এরা আম খায় না, মহুয়া ফুল কুড়োয় না এমন কি ফসল ও কাটেনা। 

শিলা বা পাথর পুজো, নদ - নদীর পুজো, গাছ পালার পুজো, বনদুর্গা পুজো, অলক্ষী পুজো, এমনকি কৃত্তিবাস ওঝার প্রচলিত অকাল বোধনে, গণেশের পাশে নব পত্রিকা স্থাপন কিন্তু অস্ট্রিক সভ্যতার বৃক্ষ পূজারই পরিবর্তিত রূপ বলে ধরা যায়।

প্রাচীন ভারতে এই ধরিত্রী দেবীর আরাধনা করা হত, অম্বুবাচী বা অমাবতী নাম দিয়ে। কিন্তু কিভাবে ?

প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে, কুমারী কন্যা নারীত্বে উন্নতি হয়ে যখন ঋতুমতী হন, তখনই সন্তান ধারণের সক্ষম হন এবং মাতৃ জাতিতে উন্নত হন।

কামরূপ , কামাখ্যা মন্দির। ছবি-লেখক
সেভাবেই কৃষি নির্ভর ভারতীয় সভ্যতার ধারক ও বাহকেরা বিশ্বাস করতেন যে , আষাঢ় মাসের সাত তারিখ থেকে দশ তারিখ অবধি মাতা বসুন্ধরা ঋতুমতী হন। অবশ্যই এই বিশ্বাসের ভিত যুক্ত আছে প্রাচীন ভারতের কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে। অর্থাৎ অম্বুবাচী আদতে একটি কৃষিভিত্তিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মনে করা হত, নারী যেমন ঋতুচক্রের ফলে সন্তান ধারণের অধিকারী হতে পারেন, তেমনি আষাঢ় মাসে ঋতুমতী বসুন্ধরা , ভবিষ্যতে শস্যপূর্ন বসুন্ধরা রূপ ধারণ করে তাঁর অগুনতি সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেবেন।
এই কারণেই এই চারদিন কৃষকেরা জমিতে হাল দেননা, মাটিই স্পর্শ করেন না। সন্ন্যাসী ও যোগীরা কোনরকম ভাবে মাটিকে আঘাত করেন না। পৃথিবীর বুকে আগুন না ধরিয়ে, ফলমূল এবং কাঁচা দুধ পান করেন।  কিন্তু এই একই পদ্ধতি বর্তমানে কেবলমাত্র বিধবা  নারীরাই কেন পালন করেন, আমার মাথায় আসে না।
এখানে একটি কথা বলতে চাই। মার্কেন্ডেয় পুরানে দেবী চণ্ডী কে শাকাম্ভরি ও বলা হয়েছে, অর্থাৎ কৃষি দেবী। অনেক বলেন বাংলার পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে দেবী চণ্ডী কিন্তু কৃষি দেবী টুসুর আরেক রূপ। টুসু পুজো তাই সীমান্ত বাংলার কৃষি উৎসব, যা শুরু হয় অম্বুবাচী থেকে এবং সমাপ্ত হয় ১ মাস ধরে চলা টুসু পরবে। অবশ্য টুসু শব্দটি মনে হয় ধানের তুষ থেকে এসেছে।  অর্থাৎ সেই কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থাই এর ভিত্তি।

কামরূপ , কামাখ্যা মন্দির। ছবি-লেখক
অম্বুবাচী উৎসব পালনকে ধর্মীয় রূপ দিতে বলা হয়েছে যে, কামরূপের কামাখ্যা দেবীও এই কদিন ঋতুমতী থাকেন। মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে, কিন্তু এই কদিন সারা ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ ভক্ত মন্দির চত্বরে বসে কীর্তন গান করেন। হাজার হাজার নারী ভক্তরা কলস যাত্রা করেন।ছোট ছোট লাল কাপড়ের টুকরো মাথায় ও হাতে বেঁধে ভক্তরা ঘুরে বেড়ান।

সামাজিক ও ধর্মীয় শুচিবাই গ্রস্ত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যখন বিজ্ঞানের এত অগ্রগতির দিনেও ,  সুস্থ স্বাভাবিক শারীর বৃত্তিও প্রক্রিয়াকেও অশুচি বলে আখ্যায়িত করতে চায়,  অনেক মন্দির যখন ঋতুযোগ্য মেয়েদের প্রবেশ রুখতে চায়, তখন কি আমরা বিস্মৃত হই যে, কোন সেই সুদূর অতীতে আমাদের পূর্বপুরুষেরা মাতৃ শক্তির ঋতুচক্রের প্রতীক , ছোট ছোট লাল কাপড়ের টুকরোকে কেমন অবলীলায় ভক্তি ও সামাজিক স্বীকৃতি দিতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হননি।

কামরূপ , কামাখ্যা মন্দির। ছবি-লেখক
আগে অম্বুবাচীর দিনে বাংলার অনেক ঘরেই কলাগাছের মান্দাস নির্মাণ করা হত। এর উপরে কলাপাতা  ঢাকা দিয়ে, সেই কলাপাতার উপরে একটি কাদামাটির ঢেলা বা ঢিপি তৈরি করে, সেই ঢিপির উপরে সিঁদুরের ফোটা , আতপ চাল, ধুপ, ধান দূর্বা, তুলসী পাতা ইত্যাদি দিয়ে লক্ষ্মী পুজো করা হত। পুজোর নৈবেদ্য হিসাবে দেওয়া হত অনেক রকমের কাটা ফলমূল এবং কাঁচাদুধ। পুজো শেষ করে প্রসাদ বিতরণের পরে , মান্দাসটিকে ভাসিয়ে দেওয়া হত। এখন আর এরকম উৎসব পালন হয়না।
ধরিত্রী মাতাকে প্রনাম করে বলি- 

মাতা জননী ধরিত্রী, দয়াদ্র হৃদয়া সতী।
দেবীভ্যো রমণী শ্রেষ্ঠা নির্দ্দোশা সর্বদুঃখ হারা।

সন্ধা-আরতি, কামরূপ , কামাখ্যা মন্দির। ছবি-লেখক
তথ্যসূত্র- বাংলার সংস্কৃতি: লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়। পালযুগ, গুপ্তযুগ, সেনযুগ থেকে অদ্যাবধি। নারায়ণ সামাট। দেশ প্রকাশন।

ছবি- লেখক। কামরূপ কামাখ্যা মন্দিরের।