বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।
সাঁওতালরা - কিসকু, মুর্মু, হাঁসদা, সরেন,
টুডু,মানডি, বাস্কে , বেদিয়া, বেসরা, পাউরিয়া, চোঁঁড়ে, হেমব্রম এই বারোটি পারিস বা গোষ্ঠী বা গোত্রে বিভক্ত। আরেকটা কথা- সাঁওতালরা প্রকৃতির উপাসক, মূর্তি পুজো করেনা।
এই বলি উৎসব কিন্তু হবে দ্বিতীয় দিনে, অর্থাৎ আগামীকাল, যাকে বলা হয় সারদি-র দিনে।
রাত নয়টায় ঢুকলাম- প্রধান পুরোহিত বা নাইকির বাড়ির উঠানে। লোকে লোকারণ্য। দুই দিকে বাজনাদারেরা বসে গ্যাছে তাঁদের বাজনার যন্ত্র নিয়ে।আরেকদিকে মেয়েরা বসে । আধো অন্ধকারে এক আধি দৈবিক, আধি ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ধামসা, মাদল, রেগড়া, সাঁকোয়া কত রকম বাদ্যযন্ত্র , বিশাল জায়গাজুড়ে কি অসাধারণ একটি পরিবেশ তৈরি করেছে, লিখে বোঝান যাবেনা। তিনদিনের উৎসবের আজকে অনুষ্ঠানের প্রথম দিন, ওঁরা বলেন
![]() |
বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।ছবি-লেখক |
চলুন আমার সঙ্গে আমার দেশ, আমার বাংলা, আমার ভারতবর্ষের দর্শনে, ধামসা মাদলের খোঁজে- বাঁকুড়া জেলার সাঁওতাল আদিবাসী অধ্যুষিত বাঁশকানালি গ্রামে। এখানে প্রতি বছর বুদ্ধ পূর্ণিমার পরের পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয় "বাহা- মা: মড়ে অনুষ্ঠান"।
সাঁওতাল উপজাতিদের নিয়ে কিছু বলা যাক।এরা বিশ্বাস করে এদেরই পূর্বপুরুষ ছিলেন একলব্য, যাঁকে অত্যন্ত অন্যায় ভাবে দ্রোনাচার্য তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুল গুরুদক্ষিণা হিসাবে চেয়েছিলেন। তাই জানেন কিনা জানিনা, আজকেও সাঁওতালরা তীর ছোড়ার সময় বুড়ো আঙুল ব্যবহার করে না। অবশ্য এরকম অন্যায় কাজের উদাহরণ তো আমাদের দেশে ভুরি ভুরি ঘটেছে- শত শত একলব্য, শম্বুকদের কথা আর কেই বা মনে রাখে !
![]() |
বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া। |
সাঁওতালরা - কিসকু, মুর্মু, হাঁসদা, সরেন,
টুডু,মানডি, বাস্কে , বেদিয়া, বেসরা, পাউরিয়া, চোঁঁড়ে, হেমব্রম এই বারোটি পারিস বা গোষ্ঠী বা গোত্রে বিভক্ত। আরেকটা কথা- সাঁওতালরা প্রকৃতির উপাসক, মূর্তি পুজো করেনা।
সাঁওতাল নামে এঁদের পরিচিতি পরে হয়েছে, আদিতে একদা ১২ টি বিভিন্ন জাতি- কোল, ভীল, মুন্ডা, ওঁরাও, কুর্মি, সাঁওতাল, বিদিয়া, বিড়হড়, কোড়া, গন্ড, দেশওয়ালী এবং মাহালি- এঁদের নিয়েই ছিল বৃহত্তর খেরওয়াল গোষ্ঠী। পরে এরা ভাগ হয়ে যায় ভিন্ন ভিন্ন জাতি হিসাবে।
সাঁওতাল উপজাতিদের বাহা- মা: মড়ে উৎসবে মেতে ওঠার আগে এবং কিছু বলার আগে রাঢ় বাংলা এবং বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কিছু দরকার আছে বলে মনে হয়।
আমরা বাঙালিরা গর্বিত আর্য জাতি, আমাদের নিয়ে কবি লেখেন-" মোক্ষ মুলার বলেছে আর্য,/ সেই থেকে মোরা ছেড়েছি কার্য।"
দেখে নিই আমরা কতটা আর্য, আর যাঁদের আমরা অনার্য বলছি, তাঁদের নিয়েও কিছু আলোচনা করছি। আর্য জাতি তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে যখন ভারতে, ভালো করে বললে উত্তর ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত আছে, বাংলাদেশে তখন আদিতম দ্রাবিড় গোষ্ঠী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিম জনজাতি গোষ্ঠী বা প্রটো অস্ট্রোলয়েড গোষ্ঠীর লোকেদেরই বসবাস। এরা ছিল অতি উন্নত জাতি, এরা অস্ট্রিক ভাষায় কথা বলত।
পরবর্তী কালে অবৈদিক আর্য যেমন আলপিও, দিনারিও ইত্যাদি জন গোষ্টিও বাংলার মাটিকে বাসভূমি হিসাবে গ্রহণ করে থিতু হয়ে বসে। এই দ্রাবিড় এবং মুখ্যত অবৈদিক আর্য আলেপিও , দিনারিও গোষ্ঠীর লোকেদের সঙ্গে অস্ট্রিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারক গোষ্ঠীর মিলনের ফলেই আজকের বাংলাদেশের বাঙালি গোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক উৎপত্তি। অর্থাৎ বাঙালি হচ্ছে মিশ্র শংকর জাতি।বৈদিক আর্যদের বঙ্গ বিজয় এবং বৈদিক সংস্কৃতির আবির্ভাব এর অনেক পরের ঘটনা।বঙ্গ সংস্কৃতিতে অনার্য প্রভাব নিয়ে বলা যায় যে নৃতাত্ত্বিক ভাবে বাঙালি যে উন্নত জাতি তার কারণ হচ্ছে, বাঙালির রক্তে আছে তিনটি সভ্যতার - প্রোট অস্ট্রোলয়েড, দ্রাবিড় এবং মিশ্র আর্যভাষী- সভ্যতার মিশ্রণ। তাই বঙ্গ সংস্কৃতি বলতে কেবল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি আদৌ বোঝায় না। এর পরতে পরতে মিশে আছে আদিম জনজাতি, অবৈদিক সভ্যতার প্রভাব।
তাই বিদেশি পন্ডিতেরা যখন বলেন বহিরাগত আর্যদের দ্বারা ভারতবর্ষের সু সভ্যতার প্রচলন ঘটেছে , তখন বোঝা যায়,এনাদের চেতনায় ছড়িয়ে আছে, ভারতীয়দের সম্মন্ধে এক তুচ্ছতাচ্ছিল্য মনোভাব। বাইরের সভ্যতার সংস্পর্শে এসেই ভারতীয়রা সভ্য হয়েছে। এর থেকে মিথ্যা মিথ আর হয়না- অতি উন্নত সিন্ধু সভ্যতার প্রচলন কারা করেছিল ? কোথায় ছিল তখন সভ্য আর্যরা ?
সুর- অসুর, আর্য-অনার্য ইত্যাদি শব্দগুলি নিয়ে চমৎকার নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন সুহৃদকুমার বাবু তাঁর আর্য রহস্য বইয়ে। তাঁর লেখা কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি-" আমরা সকলেই জানি যে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর কিছুই নয়, খুব কম হলেও চারটি মৌলিক ভাষা-গোষ্ঠীর মানুষের সমবায়ে গঠিত এক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। কাল অনুসারে তারা হল অস্ট্র-এশিয়াটিক কোল গোষ্ঠী
, দ্রাবিড়, ইন্দো- যুরোপীয় বেদিয়া শ্রেণী ও ভোটচিনীয়।। ম্যাক্স মুলরের সময় থেকে বিনা কারণে যাযাবর জাতিটি সহসা আর্য নামে অভিহিত হতে লাগল।ঐ যাযাবর জাতিটি ছাড়া অপর সকলেই ছিল স্থায়ী বসবাসকারী কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠী। আর যাযাবর বেদিয়ারা স্থায়ী বসবাসকারী মানুষের কাছে আসত ঔষধ বিক্রয় করতে, তুকতাক করতে আর সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য দুর্বোধ্য সব জাদুমন্ত্রে ভগবানকে ডাকতে।....."
রাত প্রায় আটটা, আমরা এসে পৌঁছেছি , বাঁকুড়া জেলার সাঁওতাল আদিবাসী অধ্যুষিত বাঁশকানালি গ্রামে । এখানে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বাহা- মা: মড়ে অনুষ্ঠান , প্রথম দিনের অনুষ্ঠান হবে ওঁদের পুরোহিত বা নাইকির বাড়ীতে। সিমলাপাল থেকে এই গ্রামের দূরত্ব ১০ কিমি র মতন।
আমরা উঠেছি, শ্রী মহেন্দ্রনাথ সরেন এই বাঁশকানালি গ্রামের মোড়লের বাড়িতে। এনার ছোটভাই ডাক্তার এবং আমার স্ত্রীর সহকর্মী। ডাক্তার ও সপরিবারে এসেছে। একগাড়ি পল্টন এসে তিনদিনের জন্য খুঁটি গেড়ে বসলাম, মোড়লের বাড়িতে। কিন্তু মোড়ল ই তো এই আনন্দ উৎসবের মুখ্য হোতা। আমাদের সামলাবে কে ? কুছ পরোয়া নেই, মোড়ল মশাইয়ের বৌদি, আমাদের সবার বড় বৌদি, সদা হাস্যময়ী , সাক্ষাৎ মা অন্নপূর্ণা- মকরি সরেন বৌদি স্বেচ্ছায় সব ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। তার আগে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা এসে সোনা রঙের কাঁসার ঘটি থেকে জল ঢেলে, কাপড় দিয়ে পা মুছিয়ে দিয়ে, একে একে সবাই ভূমিষ্ট হয়ে প্রনাম করল। কিচ্ছু করার নেই, এই রীতিই এখানকার দস্তুর। সরল আদিবাসীদের এই অকৃত্রিম ভালোবাসায় চোখ ভিজে উঠবে। নব্য বঙ্গজদের কাছে, এসব হয়ত ফালতু মনে হবে। বাচ্চা মেয়ে বলতে যাঁদের বুঝিয়েছি, সেই শান্তি হেমব্রম, শ্যামলী সরেন ইত্যাদি ভাইজি, ভাগ্নীরা সবাই কমপক্ষে এম এ পাস এবং স্কুল শিক্ষিকা।
বিশাল উঠোন, পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। সারি সারি খাটিয়া পাতা। এতেই চলেছে, গান, আড্ডা, নাচের মহড়া। তালবাদ্যের রণ সংগীতে, এর মধ্যেই রক্ত গরম হতে শুরু করেছে। ঝকঝকে নিকানো উঠোনে, এই বাড়ির মেয়েদের হাতে বোনা আসনে বসে, বড় বৌদির হাতের অমৃত সম রান্নার স্বাদ, সারা জীবনের মণিকোঠায় তোলা থাকলো।
মোড়ল মশাইকে ঘিরে গল্প শুনছি। ঠিক গল্প নয়, অজানা সংস্কৃতির গল্প। এই গল্প আমাদের শোনানো হয়না। যে অস্ট্রিক সভ্যতা- ভারতীয় সভ্যতার অন্যতম ভিত্তি, তাঁদের কথা তাঁদের উত্তরসূরিদের মুখ থেকেই শোনা যাক।
মহেন্দ্রনাথ সরেন হচ্ছেন মোড়ল বা মাঝি হাড়াম। ইনি হচ্ছেন এই গ্রাম সমাজের মুখ্য কর্তা। এ ছাড়াও আরো চারজন কর্তা আছেন। পারানিক বা পরামানিক , পরামানিকের সহকারী- জগ পারানিক, গোড়ায়েৎ বা কাইলি( উৎসবের বার্তাবাহক), জগ মাঝি( মরাল পুলিশ বলা যায়)।
এই যে বাহা- মা মড়ে অনুষ্ঠানে আমরা এসেছি, এর নির্ঘন্ট কিন্তু তৈরি করেছেন- সমাজ কর্তারা মিলে । একটি (জেনারেল বডি মিটিং) আলোচনা সভা বা " কুলহি দুড়ুপ:" এ বসে এই নির্ঘন্ট তৈরি হয়েছিল।
মা: অর্থ জাহেরআয়ু মা, যিনি আবার সৃষ্টিকর্তা মারাং বুরুর স্ত্রী। আর মড়ে অর্থ পাঁচ। বৃহত্তর অর্থে পাঁচ ঠাকুরের কাছে মানসিকের কমপক্ষে পাঁচটি পাঁঠা/ছাগল বলি। বসন্ত উৎসবের বা ফুলের উৎসবের অনুষ্ঠান বাহা পরব তো চৈত্র মাসে হয়ে গেছে। কিন্তু বংগা দেবতার থানে যারা মানসিকের ব্রত করেছিল, সেই মানসিকের ব্রত রাখা মানুষ গুলির জন্য, বুদ্ধ পূর্ণিমার পরের পূর্ণিমায় এখানে পালন করা হয় মা: মড়ে উৎসব। মারাং বুরু, জাহেরআয়ু, মড়ে-কো-তুড়েইক, সেন্দ্রা বঙ্গা, হারাং বঙ্গা- এই পাঁচটি মুখ্য দেব-দেবীর থানে চারটি পাঁঠা ও একটি ছাগি বলি হচ্ছে পুজোর অঙ্গ। জাহের আয়ু দেবীর নামে ছাগি বলি হয়।
এক সময়ে মা- মড়ে পুজোর সূচনায় বা কুটাম ডাংরিতে গো দান করা হত। এখন মূল্য ধরে দেওয়া হয়।
এই মুখ্য দেবতাদের থানেই আছেন রস্কে বঙ্গা। ইনি সাঁওতাল সমাজের রসে বসে থাকা আনন্দের ঠাকুর বলতে পারি।
![]() |
বাঁয়ে ধামসা, ডাইনে রেগরা বাদকের দল। |
![]() |
১ ম দিনের পু জো শুরু হয়েছে, ছবি লেখক। |
ওঁম ।
বাঁ দিকে মুখ্য পুরোহিত বা নাইকি- বীরেন সরেনের ঘর। মূল ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছে, নাইকির উঠানের তুলসী মঞ্চ ঘিরে। নাইকির সহকারী একটি কম বয়সী ছেলে- যাকে ডাকা হয় " কুডম নাইকি" বলে।
ধামসা বা নাগারা আদিতে রণসঙ্গীত হিসাবে যুদ্ধের সময় বাজানো হত। তবে বর্তমানে মানভূম এবং ছোটনাগপুর জেলার বিভিন্ন নৃত্যগীত এবং শোভাযাত্রায় ব্যাপকভাবে এটি বাজানো হয়। ধামসা বা নাগারার অন্য নামগুলো হচ্ছে টিকারা, দামামা, ঢক্কা, ডঙ্কা ইত্যাদি।
আগে শিশুকাঠ দিয়ে ধামসার খোল তৈরি হতো। তবে বর্তমানে লোহার চাড়ির মুখে গরু বা মহিষের চামড়া দিয়ে এর ছাউনী তৈরি হয়। ছাউনী তৈরিতে গাব(গাব ফলের আঠা) বা খিরণ লাগানো হয় না।
ধামসা দুটি মোটা কাঠির সাহায্যে বাজানো হয়। ধামসা কিন্তু ছোট ও বড় - দুটি মাপের হয়। বোলের শব্দ শুনে দ্রিমি দ্রিমি, দ্রিম দ্রিম ধ্বনি বলে মনে হয়। বাঁশ পাহাড়ির অনুষ্ঠানে দুই সাইজের ধামসা দেখতে পেলাম।
প্রায় এরকমই আওয়াজ বেরোচ্ছে আরেকটি বিশাল বাদ্যযন্ত্র থেকে। এটির নাম রেগড়া। এটি কিন্তু সমান দৈর্ঘ্যের দুটি কাঠি দিয়ে বাজানো হচ্ছে।
বিশাল আকারের মহিষের শিঙে প্রস্তুত আরেকটি বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে সাঁকোয়া। শিঙের মধ্যে একটি ফুটো থাকে। এই ফুটোতেই ফুঁ দিয়ে সুর তুলছে। মধ্যে মধ্যে শিল্পীকে যন্ত্রের মধ্যে জল ঢেলে পরিষ্কার করতে দেখলাম। সাঁকোয়া বহু প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র। একজন শিল্পীর সঙ্গে আলাপ হল- উনার নাম লখিন্দর মুর্মু। উনি এই যন্ত্র বাজাতে শিখেছেন উনার গুরু মহেন্দ্রনাথ সরেনের কাছে।
এবার আসি মাদলে।
![]() |
মহিষের শিঙে প্রস্তুত আরেকটি বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে সাঁকোয়া। |
এবার আসি মাদলে।
মাদল দেখতে অনেকটা সিলিনড্রিকাল , এরকমই দেখতে একটু ছোট বাদ্যযন্ত্র কে লাগা বলে। এটি তৈরিতে পোড়ামাটির খোল লাগে। এখানেও খোলা মুখ দুটিতে গরু/মোষের চামড়ার ছাউনী লাগানো হয়। ছাউনির মাঝখানে গাব ফলের আঠা বা খিরণ লাগিয়ে চামড়া শক্ত ও টেকসই করা হয়। এছাড়া খোলের উপর তবলার মতন সরু সরু চামড়ার ফিতের বাঁধি লাগানো হয়। নাচ গানের সময় বেশির ভাগ জায়গায়, দুটি মাদল এবং একটি লাগা ব্যবহার করা হয়। তাই দুটি মাদল এবং একটি লাগা নিয়ে মাদলের একটি সেট হয়। আদিবাসী নাচে গানে, ঝুমুর গান এবং নাচে, মাদল বাজবেই।
খোলও একটি পোড়ামাটির বাদ্যযন্ত্র। মৃৎ বা মাটির তৈরি বলে এর আরেকটি নাম মৃদঙ্গ। খোলের আকার অনেকটা কলার মোচার আকৃতির। দুই দিকের খোলা মুখ দুটিতে চামড়ার আচ্ছাদন বা ছাউনী লাগানো হয়। ডানদিকের মুখটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র , বামদিকের মুখের চেয়ে। এখানেও চামড়ার মাঝখানে গাব বা খিরণ লাগান হয়।বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে, কীর্তন গানের সঙ্গে খোলের বহুল ব্যবহার করা হয়, তাই একে কীর্তন খোল ও বলে।
রাত একটা বেজে গেছে, , নাচ- গান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছেই। শুনলাম চলবে রাত তিনটে অবধি। অনেকের উপরে দেখলাম দেবতার ভর হয়েছে। তাঁদের ব্যাবহার ও চলন বলন, কেমন অদ্ভুতভাবে বদলে যাচ্ছে।
ফিরে এলাম ঘরে। সত্যিকারের রাম রাজত্ব দেখতে হলে এই সাঁওতাল গ্রামগুলিতে আসতে হবে। এত লোক রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে, বাইরে থেকে এত লোক এসেছে, বাড়ির সামনে থেকে পিছন অবধি সব দরজা/জানলা খোলা। আমি তো চাঁদের আলোয় শুয়ে পড়লাম, উঠানের খাটিয়াতে। শেষ রাতে শুনি মাথার উপরে মোরগের ডাক। তখনও ঠিকমতন আলো ফোটেনি, কিছু বুঝতে না পেরে, মাথার উপরের আমগাছে ,টর্চের আলো ফেলে চক্ষুস্থির। গাছের উপরে কাতারে কাতারে মুরগি চড়ে বসেছে। এমন অদ্ভুত দৃশ্য, জীবনে প্রথম দেখলাম।
পরের দিন সকালে এই মুরগি রহস্য উদ্ধার হল। এখানে প্রত্যেকের ঘরেই লড়াকু কাশিপুর মোরগ পোষা হয়। এই মোরগ পোষা হলেও, মোটামুটিভাবে উড়তে পারে। চোর ডাকাত না থাক, মুরগির খোঁজে শিয়াল বা হুরাল প্রায় গ্রামে হানা দেয়। তাই ডারউইন সাহেবের মতকে মেনে নিয়ে এরাও শিয়ালকে কাঁচকলা দেখিয়ে, রাতের বেলা গাছের মগডালে চড়ে বসে থাকে- survival for the fittest . তবে ওদের জন্য সেকেন্ড লাইন অফ ডিফেন্স, নিঃশব্দে একটু দূরে শুয়ে থাকে। কি তাগড়াই দেশি কুকুর। এগুলোকে শিকারের জন্য সঙ্গে নেওয়া হত একসময় বলে, এদের জিনগত পরিবর্তন সাংঘাতিক হয়েছে। পারত পক্ষে গলা দিয়ে আওয়াজ করেনা। কিন্তু শেষ রাতে কালুর ডাকে, রক্ত জল হয়ে গেছিল, যেন হাউন্ড অফ বাসকারভিলের ডাক। আবার জানলাম যে, শিকারে গেলে শিঙ্গা ফোঁঁকার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি এই দেশি কুকুরগুলি একসঙ্গে ডাকতে থাকে।
বাহা- মা: মড়ে উৎসবের দ্বিতীয় দিন। বাঁশকানালি, বাঁকুড়া।
![]() |
আমগাছে মুরগি, বাপের জন্মে দেখিনি। |
![]() |
কাশীপুর মোরগ ব্রিড করা হচ্ছে, |
বাহা- মা: মড়ে উৎসবের দ্বিতীয় দিন। বাঁশকানালি, বাঁকুড়া।
আগেই লিখেছি, বাহা- মা: মড়ে উৎসবের দ্বিতীয় দিনটিকে বলা হয় সারদি।
সকালে উঠে প্রথমে গেলাম সবজি তুলতে, আজ্ঞে হাঁ- সবজি কিনতে নয়, খেত থেকে সবজি তুলতে।
মোড়ল মশাইয়ের বিশাল খেত, তবে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। আর গাছের আম পাড়া হল। দুটি গাছে ১০০ র মতন এচোড় ধরেছে, কিন্তু পাড়তে পারলাম না, এত বিশাল সাইজ, নিয়ে যাব কি করে।এরপর ব্রেকফাস্ট খেতে বসলাম ,মেঝের উপরে হাতে বোনা আসনে, শাল পাতার থালা-বাটিতে। এরা পরিবেশ নিয়ে শুকনো ভাষণ দেয়না। আপনি আচরি ধর্ম পালন করে দেখায়। তাই এত শিক্ষিত ও আধুনিক হয়েও, জঙ্গলে গিয়ে শালপাতা ও নিমের পাতা নিয়ে আসে। এই থালা,বাটি ঘরে তৈরি হয়েছে, শালের পাতা ও নিম গাছের শুকনো কাঠি বা চাবেচ দিয়ে। থালা বাটি তৈরি করার জন্য রীতিমতো একটি ট্রেনিং ক্লাস নিল ভাগ্নি মিনতি মুর্মু।
আর মোড়ল মশাইয়ের কাছে শিখলাম, শাল পাতার বিড়ি বা চুটটা বানাবার কৌশল। রোমে গিয়ে রোমান না হলে কি চলে !
রীতিমত ভীতিপ্রদ, বিশাল চেহারার একটি চ্যাম্পিয়ন কাশিপুর মোরগ, উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টিয়া পাখির মতন ঠোঁট, ময়ূরের মতন লেজ মাটিতে লুটিয়ে চলেছে, উচ্চতায় কম করে ফুট দুয়েক, বয়স শুনলাম একবছর মাত্র। মোরগ লড়াইয়ে ওকে দেখেই, অপনেন্ট পগারপার ।
![]() |
আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। |
![]() |
বাগানে এত বড় বড় এঁচোর ঝুলছে। |
![]() |
মাছ ধরতে নদীতে যাওয়া। |
![]() |
খেত থেকে তোলা সবজি । |
![]() |
শালপাতার থালা বাটি তৈরির ট্রেনিং। |
![]() |
শালপাতার চুটা। |
রীতিমত ভীতিপ্রদ, বিশাল চেহারার একটি চ্যাম্পিয়ন কাশিপুর মোরগ, উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টিয়া পাখির মতন ঠোঁট, ময়ূরের মতন লেজ মাটিতে লুটিয়ে চলেছে, উচ্চতায় কম করে ফুট দুয়েক, বয়স শুনলাম একবছর মাত্র। মোরগ লড়াইয়ে ওকে দেখেই, অপনেন্ট পগারপার ।
উঠোনের খাটিয়াতে শুয়ে শুয়ে বাড়ির সবার কাছ থেকে, বঙ্গ সংস্কৃতির এক অজানা পর্বের গল্প শুনছি। আর বড় বৌদি সমানে টুকটাক মুখ চালাবার সামগ্রী সাপ্লাই করে চলেছেন।
বহিরাগতরা হচ্ছে দিকু, খালি সাঁওতাল গোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদের পরিচয় দেয় হড়(মানুষ) বলে। এঁদের আদি পুরুষ হচ্ছে পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুরহি। জাতিতে খেরওয়াল।
ওঁদের গানেই আছে-
" এ বাবা পিলচু হারাম, এ আয়ো পিলচু বুরহি,
জানাম বাবা বেন জানাম কেৎলিঞ, জৌত বাবা বারেন এমাৎলিঞ ।
জৌতি হো জৌতি গে জৌতি খেরওয়াল।"
অর্থাৎ পিলচু বুড়ো ও পিলচু বুড়ি, আমাদের তো জন্ম দিলে। কিন্তু আমাদের জাতি কি ? জাতি হে জাতিই জাতি, খেরওয়াল জাতি তোমরা।
সাঁওতালদের আদি সমাজ হচ্ছে- বিন্দির হড় সমাজ। পরে আদি সমাজ থেকে বেরিয়ে গিয়ে সাফা হড় সমাজ ও ইসৈঁঁয় হড় সমাজ নামে আরো দুটি সমাজ গড়ে ওঠে।
সাঁওতাল সমাজে কিন্তু স্বগোত্রে বিবাহ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এছাড়াও শুনলাম
বেসরার সঙ্গে টুডু এবং মাণ্ডির সঙ্গে কিস্কু গোত্রের বিবাহ হয়না।
বিন্দি সমাজে ডালার মধ্যে আর সাফা সমাজে বিয়ের মণ্ডপে (মারওয়া) বিয়ে হয়। বিয়েকে বলা হয় বাপলা। ৪/৫ দিন ধরে বিয়ের পরব চলে। এঁদের সমাজে সাত প্রকার নামের বিবাহের প্রচলিত আছে।
১) ঘটকের(রাইবার হারাম) সম্বন্ধ করা বিয়ে বা দুয়ার বাপলা, এই বিবাহই সবচেয়ে বেশি হয় ।২) ইপতুৎ অর বাপলা,। ৩)শাঁখা বাপলা।, ৪) ঘরদি জায়ায় বাপলা ।, ৫) টুনকি দিপিল বাপলা,(পাত্রী পক্ষ যদি বিয়ে দিতে অসমর্থ হয়, তখন ছেলের বাড়িতে বিয়ে হয়)।, ৬) অর বাপলা।, ৭)আপাঙ্গির বাপলা (অপহরণ করে বিয়ে) ।
দুয়ার বাপলা বিয়ের প্রথমে হয় পাকা দেখা( ঞেপেল), এটি সাধারণত মেয়ের বাড়িতেই হয়, তবে ছেলের বাড়িতেও হতে পারে।এর পরে হয় সামান্য কনেপন বা "গনং এপেম " দেওয়া। সঙ্গে তত্ব হিসাবে মেয়ের মা, মাসি ও পিসীদের জন্য শাড়ি দেওয়া হয় । তবে অনেক সময় গাভী সম্প্রদানের প্রথাও প্রচলিত ছিল , জানতে পারলাম যে মোড়লের ছোটভাই ডাঃ রাজেন্দ্রনাথ সরেন, তাঁর বিয়েতে দুধেল গাই দিয়েছিলেন। ওঁর স্ত্রী শ্রাবনীর মুখে এই কথা শুনে সমবেত স্রোতাদের মধ্যে হাসির রোল পরে গেল।
এরপরে মেয়ের বাড়ির মত নিয়ে একদিন ঘটক কনে ও তার গুটিকয়েক বান্ধবীকে , বরের বাড়িতে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে যান। এই অনুষ্ঠানকে বলে কিচরিচ বান্দি। শেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে বালায়া জহার। মেয়ের বাড়ির লোকেরা ছেলের বাড়িতে গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচিত হন। বরকে নতুন ধুতি পরিয়ে ভোজের( জমঞু) অনুষ্ঠান হয়।
শেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে বিবাহ মণ্ডপ বা " মারোয়া" তৈরি করে দুই বাড়িতেই তেল-হলুদ মাখান বা " তেলাই দান" পর্ব। আর রয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠানে কুলোর মধ্যে ধান-দূর্বা, আতপ চাল, মিষ্টি ইত্যাদি রেখে বরণ করা । কুলোকে সাঁওতালরা মনে করে লক্ষ্মীর চিন্হ, এবং ধান - দূর্বা দিয়ে বরণ করলে ধরা হয়, নবদম্পতি দীর্ঘায়ু ও সুখী হবে। যে কোন আদিবাসী বিয়ের মুখ্য অনুষ্ঠান হচ্ছে সিঁদুর দান। তাহলে মোড়ল মশাইয়ের কাছ থেকে কি জানলাম ? জানলাম যে আমাদের হিন্দু বিয়ের লোকাচার তেল-সিঁদুর মাখান, ধান- দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করা এবং সর্বোপরি সিঁদুর দান- এগুলি সবই আদতে অস্ট্রিক সভ্যতার দান । কৃষিকার্জ যেহেতু অস্ট্রিক সভ্যতার দান, তাই চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত কত অস্ট্রিক শব্দ যে আমরা ওঁদের কাছ থেকে পেয়েছি, আমরা নিজেই তা জানিনা, যেমন- লাঙ্গল, ধান, বেগুন, পান, লাউ, নারকেল,হলুদ, সুপারি, কাপাস, পাট, বাছুর, দা, করাত, ঢেঁকি, মুড়ি- এ শব্দ রাশি শেষ হবার নয়। এমনকি বঙ্গ , গঙ্গা ইত্যাদি নামগুলিও আদতে অস্ট্রিক শব্দ।
আরো দুটি বিয়ের কথা জানলাম। বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ের বিয়েকে বলে সাঙ্গা। আর একবাড়ির ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে অন্য বাড়ির মেয়ে ও ছেলের পালটি বিয়ে হচ্ছে " গোলাত" বিয়ে।
এরপর যখন কোন সন্তান জন্মায় তখন সারা পরিবার শুধু নয়, পুরো গ্রামে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়, কারণ এঁদের শিশু জন্মহার বেশ কম। বাচ্চার মাথার বালিশের নীচে অপদেবতার প্রভাব কাটাতে একটি লোহার টুকরো রাখা হয়। সুবিধা মতন ১/২/৩/৫/৭ দিন পরে ঘরদোর গোবর দিয়ে তকতকে করে নিকানো হয়। বাচ্চাটার মস্তক মুন্ডন ও নখ কাটার জন্য আসে নাপিত। জিওণগাডা বলে একটি লোকাচার অনুষ্ঠান হয়, সকালে হয় নিমপাতা সহ খিচুড়ি রেঁধে খাওয়া। পরে হয় মুড়ি সহযোগে হাঁড়িয়া পান। প্রথম সন্তান ছেলে হলে ঠাকুরদা ও মেয়ে হলে ঠাকুমার নামে নামকরণ করা হয়। বেশিরভাগ বাড়িতে পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে ৬ মাসে এবং কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে ৭ মাসে অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠিত হয়।
আর সাঁওতালদের মধ্যে কেউ মারা গেলে দাহকার্য এবং কবর দেওয়া প্রচলিত আছে। গর্ভবতী নারী এবং শিশু মারা গেলে কবর দেওয়া হয়, অন্যথায় দাহ করা হয়। সাধারণত বড় ছেলে মুখাগ্নি করেন, অভাবে মৃতের নিকটজন কেউ। অস্থিভস্ম আর কাদা মিশিয়ে একটি তাল বানিয়ে মাটির হাঁড়িতে পুড়ে বাড়ির চালে বা মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। পাঁচদিন পরে হয় " তেলনাহান" অনুষ্ঠান। অস্থি কলস সাধারণত কোন নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।বাড়ির সবাই চুল, নখ, দাড়ি কেটে, স্নান করেন।
এরপর ১৫ দিনের মাথায় হবে শ্রাদ্ধ বা " ভাড়াঁঁন" অনুষ্ঠান। গোবর লেপা উঠোনে একটি সজনে গাছের ডাল পুঁতে অনুষ্ঠান স্থল তৈরি করা হয়। মারাংবুরু এবং পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে মুরগি, ছাগী, শুকরী শেষে পায়রা বলি হয়। আর পুজোর প্রসাদের সঙ্গে থাকে হাঁড়িয়া।
সাঁওতাল সমাজে অসংখ্য পরব। অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন, ফাল্গুন মাসে দোল(বাহা)- ছাড়াও আরো অনেক পরব উদযাপিত হয়। যেমন আষাঢ় মাসে এরক- সিম, ভাদ্রমাসে গুণ্ডলী, অগ্রহায়ণ মাসে যন্থর পুজো, পৌষ সংক্রান্তিতে সংক্রান্ত পুজো, মাঘ মাসে- মাঘ সিম পুজো ইত্যাদি। আমার ছোটবেলায় আষাড়িয়া সিম পুজো তো চাষের জমিতে হতে দেখেছি। আষাড় মাসে, জলভরা কাদা জমিতে ধান চারা রোপন করার আগে এই খেত পুজো হত।
কিছুক্ষণের জন্য শিলাবতী নদীতে ঘুরে আসা গেল, জল প্রায় নেই।
![]() |
শিলাবতী নদীতে ঘুরে আসা গেল। |
কিছুক্ষণের জন্য শিলাবতী নদীতে ঘুরে আসা গেল, জল প্রায় নেই।
তারপর কানে ভেসে এল জাহেরআয়ু থান থেকে ধামসা- মাদলের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। ছুট-ছুট জাহেরআয়ুর থানে।
কাতারে কাতারে লোকে এসে ভীড় জমিয়েছে। একটি মাচা বানিয়ে তার উপরে শাল পাতা, শাল ফুল, মহুয়া ফুল, আমপাতা দিয়ে সাজান হয়েছে।
মাচার নীচে পুজোর আয়োজন। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে মেয়েরা হাতে হাত ধরে নাচ করছে।
কি অসাধারণ সেই পরিবেশ। বলির পরে হল , মাংস ও খিচুড়ি ভোগ।কি দারুন লাগছিল এই সহজ সরল মানুষগুলির সঙ্গে বসে পঙক্তি ভোজ খেতে। এরপরে বলির উদ্বৃত্ত মাংস সবার বাড়িতে বিতরণ করা হল, জানিয়ে রাখি এই বাঁশকানালি গ্রামে সর্বমোট ৮৫ টি বাড়ি আছে। অনুষ্ঠানের সমস্ত খরচ প্রতিটি বাড়ির লোকেরা সমান ভাবে বহন করে। কোন রকম চাঁদা তোলা বা নেওয়া হয়না। তবে নাচ গানের আসরে আপনি টাকা দিলে, ওরা মাইকে অ্যনাউন্স করে আপনার দান গ্রহণ করবে।
ফেরার সময় রাতের নাচের স্পেশ্যাল আইটেম পাঞ্চি শাড়ি ও পাঞ্চি ধুতি সঙ্গে মাথায় বাঁধার সুন্দর একটি কাপড় কেনা হল, সুদূর উড়িষ্যা থেকে আগত সাঁওতাল তাঁত কাপড় নির্মাতাদের কাছ থেকে, পুরো কাপড়গুলো কিন্তু ঘরের তাঁতে তৈরি। রাতে তো নাচতেই হবে, আদিবাসীদের নাচের ছন্দে পা মেলান- কত যুগের লালিত স্বপ্ন আজ পূরণ হতে চলেছে ।
![]() |
ধামসা- মাদলের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। |
কাতারে কাতারে লোকে এসে ভীড় জমিয়েছে। একটি মাচা বানিয়ে তার উপরে শাল পাতা, শাল ফুল, মহুয়া ফুল, আমপাতা দিয়ে সাজান হয়েছে।
![]() |
মাচার নীচে পুজোর আয়োজন। |
মাচার নীচে পুজোর আয়োজন। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে মেয়েরা হাতে হাত ধরে নাচ করছে।
![]() |
হাতে হাতে ধরি ধরি। |
![]() |
নাচের আইটেম পাঞ্চি শাড়ি ও পাঞ্চি ধুতি। |
ফেরার সময় রাতের নাচের স্পেশ্যাল আইটেম পাঞ্চি শাড়ি ও পাঞ্চি ধুতি সঙ্গে মাথায় বাঁধার সুন্দর একটি কাপড় কেনা হল, সুদূর উড়িষ্যা থেকে আগত সাঁওতাল তাঁত কাপড় নির্মাতাদের কাছ থেকে, পুরো কাপড়গুলো কিন্তু ঘরের তাঁতে তৈরি। রাতে তো নাচতেই হবে, আদিবাসীদের নাচের ছন্দে পা মেলান- কত যুগের লালিত স্বপ্ন আজ পূরণ হতে চলেছে ।
এই জাহেরআয়ু থানেই আবার পূর্বপুরুষ দেবতা হারং বোঙ্গার থান অবস্থিত। সন্ধ্যা অবধি পুরোহিত বা নায়ক- বীরেন সরেন দেবতাদের থানেই ছিলেন। তারপর আবার ধামসা মাদল বাজিয়ে উনি ফিরে এলেন গ্রামের প্রতিটি ঘরে। সঙ্গে ঠাকুরের পুজোর জলপূর্ণ একটি ঘড়া এবং যুদ্ধ সাজে সজ্জিত ছেলেপুলের দল। আরো ছিলেন সেই সব ভক্তরা, যাঁদের উপরে দেবতার ভর হয়েছিল। এই উপলক্ষে, গ্রামের প্রতিটি ঘরের সামনে সোনা রঙের কাঁসার ঘড়ায় জল, কাঁসার বাটিতে তেল এবং একটি করে পিঁড়ি রাখা ছিল।
প্রতিটি বাড়ি থেকে দুটি মেয়ে বেরিয়ে, নায়েক এবং অন্যদেরও পা , জলে ধুইয়ে দিয়ে, তেল মাখিয়ে দেয় এবং সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। এভাবেই রাত বারোটা বেজে যায়।
সাঁওতালদের উৎসব আর নাচ গান হবেনা, তাও আবার হয় নাকি ! রাত ২ টো থেকে শুরু হল নাচ গানের এক অসাধারণ অনুষ্ঠান। সারা জীবনেও এই দিনগুলি ভোলা যাবেনা। এখন সকাল সাড়ে ছটা, অনুষ্ঠান এখনও চলছে।
![]() |
বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া। |
![]() |
বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া। |
![]() |
বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া। |
সাঁওতালদের উৎসব আর নাচ গান হবেনা, তাও আবার হয় নাকি ! রাত ২ টো থেকে শুরু হল নাচ গানের এক অসাধারণ অনুষ্ঠান। সারা জীবনেও এই দিনগুলি ভোলা যাবেনা। এখন সকাল সাড়ে ছটা, অনুষ্ঠান এখনও চলছে।
তৃতীয় দিন,অর্থাৎ আজকে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে জল খেলা, অর্থাৎ রং ছাড়া দোল খেলা ধরা যায়। চলবে শুনলাম বিকাল অবধি। সময়ের অভাবে সেই অনুষ্ঠানে থাকা হল না।
বাঁশপাহাড়ি গ্রামে গিয়ে এঁদের আচার আচরণের বিষয়ে আরো অনেক কিছু জানলাম।
সাঁওতালি ভাষায় দেবতাকে বংগা নামে ডাকা হয়। এঁদের জীবনেও বারো মাসে তের পার্বন।সহরাই, দাসাই,বাহা, বাহা- মা: মড়ে, সাকরাত, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এঁদের জীবনে বিভিন্ন উৎসব পালন জুড়ে আছে।
আদিবাসী সাঁওতাল সমাজের একটি অন্যতম পালা পার্বন ছিল শীষ বা বীজ বপনের পুজো। অনেকে এই উৎসবকে হারিয়ার সাম বা ধান বপনের উৎসব বলেন। জ্যৈষ্ঠ মাসে কৃষি জমিকে পুজো করে বীজ বপন করা হয়। সাঁওতালদের বিশ্বাস এতে কৃষি দেবী খুশি হয়ে ভালো ধান এবং ফসল দান করেন।
সাঁওতালদের দেবতা বঙ্গা আমরা অনেকেই জানি। সূর্যদেব বা সিং বোঙ্গার পুজোয় মুরগী বলির প্রচলন আছে । আবার মেরম বোঙ্গার পুজোয় ছাগ বলির প্রচলন। অর্থাৎ অস্ট্রিক সভ্যতার অন্যতম অবদান আজকের হিন্দু ধর্মের বলি প্রথার প্রচলনের ।
সাঁওতাল সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ পরব বাঁদনা বা সহরায় পরব। যদিও পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জায়গায় কালিপুজোর দিন থেকে পরবর্তী পূর্ণিমা অবধি সহরায় উৎসব পালন করা হয়, কিন্তু সাঁওতাল পরগনা, ছোট নাগপুর মালভূমির এক অংশে এবং রাঢ়বঙ্গের কিছু জায়গাতেও এটি পৌষ মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হয়ে পৌষ সংক্রান্তির আগে শেষ হয়।'ম৺ড়েসিঞ ম৺ড়ে ঞিদা' বা পাঁচ দিন পাঁচ রাতের অনুষ্ঠান হচ্ছে বাঁদনা পরব। নাচ গান আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে ভাই- বোন- জামাতা-বন্ধুদের মিলন উৎসব যেমন পালন করা হয়, তেমনি ঘর পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে গৃহপালিত পশুর যত্ন নেওয়া,সেগুলিকে চান করিয়ে, গরু মোষের শিঙে তেল সিঁদূর লাগিয়ে ধানের শীষের মুকুট পড়ানো হয়। গোয়াল ঘরে সারারাত ধরে প্রদীপ জ্বলে এবং বাঁশের বোনা নতুন কুলোয় ধান, দূর্বা, আতপ চাল, সিঁদুর এবং একটি জ্বলন্ত প্রদীপ দিয়ে গৃহপালিত পশুগুলির উদ্দেশে যে অনুষ্ঠান হয়, তাকে চুমাড়া বলে। এ ছাড়াও ছেলেরা গোয়াল ঘরের দরজার পাশে চাষের লাঙ্গল ও জোয়াল জলে ধুয়ে রাখে। মেয়েরা আলপনা দেয়। এরপরে হয় গোয়ালপুজো। বিবাহিত কন্যারা সপরিবারে এই কটা দিন পিতৃগৃহেই থাকে। যেন মা উমা আসেন বাপের বাড়িতে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি হয় গরু খেলানো উৎসব বা খুঁন্ট( খুঁটা)। এমনি করে হাসি কান্নায় দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন কখন পেরিয়ে যায়। মেয়ে আবার চোখের জলে ফিরে চলে শ্বশুর বাড়িতে।
বাঁদনা পরব, করম পরব, ভাদু, টুসু, ছৌ, দিসম সেন্দ্রা, সহরায়, বাহা, বাহা-মা মড়ে পুরো আদি মানভূম জেলা এবং ছোটনাগপুর মালভূমিতে কত না উৎসব বা পরব। এর সঙ্গে আছে ঝুমুর গান ও নাচ।
এসব নিয়েই সুরভিত হচ্ছে বঙ্গ সংস্কৃতি।
সাঁওতালদের একটি গান দিয়ে লেখা শেষ করছি-
"দেলায়া বিরিদপে দেলায়া তিঞূন পে,
জানাম দিশম লৌগিৎতে হো,
দেলায়া পায়ার:ক' তাবোন পে।"
ওঠো, জাগো, চলো জন্মভূমির জন্য এগিয়ে চলো।
এতো অনেকটা সেই বিবেকানন্দের অতি প্রিয় কঠোপনিষদের বাণীর মতন লাগছে না:-
তথ্যসূত্র:-
১) আবাদভূমি, তৃতীয় বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৬ - এপ্রিল ২০১৭।
২)সুহৃদকুমার ভৌমিক । আর্য্ রহস্য। মনফকিরা।
৩) আদিবাসী সমাজ ও পালপার্বন : ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে।লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
৪) বাংলার জনজাতি, প্রদ্যোত ঘোষ। পুস্তকবিপনি।
৫) বাংলার সংস্কৃতি: লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়। পালযুগ,গুপ্তযুগ, সেনযুগ, থেকে অদ্যাবধি। নারায়ণ সামাট। দেশ প্রকাশন।
৬)সাঁওতাল সমাজ সংস্কৃতি ও সংগ্রাম, শিবেন্দুশেখর মিশ্র। লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গ সরকার।