Thursday, September 10, 2020

 গোলকুন্ডা দুর্গ এবং এক শাহী প্রেমকথা।


                                                           অ্যানিমেশন ছবি Bhagmati.
                                               ( xbhagmati-pagespeed-ic-fxdlpoikak.jpg)                                                    

ভারতীয় নারী। ঈশ্বরের বোধহয় সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।তাঁর আছে হরিণীর মতন কালো চোখ, প্রেমিকের জন্য সমুদ্র অতল গভীর ভালোবাসা, অসম্ভব সুন্দর একটি মন এবং মনন।এই  কাজল নয়না হরিণীর চোখ, চুম্বকের মতন টেনে নিতে পারে যে কোন পুরুষকে।আর তাঁদের প্রেমের গভীরতা - জন্ম দিয়েছে কত গান, কত লোককথা, কত উপন্যাসের।

"তোমার সৌন্দর্যদূত যুগ যুগ ধরি এড়াইয়া কালের প্রহরী,
চলিয়াছে বাক্যহারা এই বার্তা নিয়া - ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া। "

এ কথা শুধু শাহজাহানের ক্ষেত্রে নয় , এর সত্যতা পাওয়া যায়  দেশজুড়ে প্রচলিত অসংখ্য ধ্রুপদী প্রেমগাঁথার মধ্যে। সে গোলকুন্ডার ভাগমতি-কুলি কুতুব শাহের উপাখ্যান হতে পারে, মান্ডুর রূপমতি- বাজবাহাদুরের হতে পারে, কুলি কুতুবের নাতি আবদুল্লা কুতুব শাহ এবং তারামতির হতে পারে ।

গোলকুন্ডা বলতেই আসে হায়দরাবাদ শহরের কথা । আর হায়দরাবাদের ল্যান্ডমার্ক কি জিজ্ঞেস করলে সবাই একবাক্যে উত্তর দেবেন জানি চারমিনার।চারমিনার কে তৈরি করেছেন জানেন ? চতুর্থ কুতুবশাহী সুলতান কুলি কুতুব শাহ-১৫৯১ এ শুরু করে ১৫৯২ এ শেষ করেন। ইনি ছিলেন এক ব্যাতিক্রমী সুলতান, কোন আনন্দ বা যুদ্ধজয়ের স্মৃতিতে এই অসাধারণ সৌধটি তৈরি হয়নি। সেই সময় গোলকুন্ডা এবং হায়দ্রাবাদে প্লেগের প্রাদুর্ভাবে ভয়ঙ্কর মড়ক দেখা দেয়।সম্রাট আল্লার কাছে দোয়া করেন তাঁর প্রজাদের প্রানরক্ষার জন্য।প্লেগের প্রাদুর্ভাব বন্ধ হলে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি আল্লার কাছে দোয়া মাঙ্গেন , ঠিক সেই স্থানেই এই অসাধারণ স্থাপত্য কীর্তিটি তৈরি করেন।

চলুন যাই কুতুবশাহী রাজবংশের রাজধানী গোলকুন্ডা দুর্গ দর্শনে। এই দুর্গ সম্ভবত ৯৪৫-৭০ খ্রিস্টাব্দে তৈরী হয় কাকাতিয় রাজাদের হাতে। সেটি তখন ছিল মাটির কেল্লা।যে পাহাড়ের চূড়ায় এই কেল্লার অবস্থান তার নাম "মঙ্গলা ভরম" পাহাড়। এর বহুপরে ১১৪৩ সালে একটি রাখাল বালক পশুর পাল চড়াবার সময় এই মঙ্গলাভরম পাহাড়ের চূড়ায় একটি গাছের তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল।খেলার ছলে গাছের ডাল নিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বেরিয়ে পড়ে এক দেবমূর্তি।ক্রমে ক্রমে এই মূর্তির কথা কাকাতীয় রাজ রাজা প্রতাপ রুদ্রের কানে যায়।রাজা এই স্থানটিকে পবিত্র ও সৌভাগ্যের আলয় মনে করেন এবং মাটির কেল্লাকে আরো শক্ত পোক্ত করে গড়ে তোলেন এবং নামকরণ করেন গোল্লাকোন্ডা। তেলেগু ভাষায় গোল্লা মানে রাখাল আর কোন্ডা হচ্ছে পাহাড়।

                                                         গোলকুণ্ডা দুর্গ । ছবি- লেখক ।    
 
এই 'গোল্লাকোন্ডা'ই লোকমুখে হয়ে দাঁড়াল গোলকুন্ডা।১৩৬৩ সালে কাকাতীয় রাজা কৃষ্ণদেবের কাছ থেকে এই দুর্গ বাহমনি সম্রাট মহম্মদ শাহের হস্তগত হলে দুর্গের নতুন নামকরণ হয় মহম্মদনগর। তবে এই দুর্গ পরবর্তীতে আবার দখলে যায় হিন্দু রাজা মুসুনারি নায়েকের হাতে। উনার উত্তরপুরুষ মুসুনারি কাপায়া নায়ক ১৪৬৪ সালে দুর্গকে বাহমনি সম্রাটদের কাছে প্রত্যর্পণ করেন। 

কালের ফেরে ১৫১৮ সালে বাহমনি সম্রাট মেহেমুদ শাহের সুবেদার কুলি কুতুব শাহ স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্বাধীন কুতুবশাহী রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। গোলকুন্ডা দুর্গ হয় এই রাজবংশের রাজধানী। এই রাজবংশের আদি নিবাস ছিল সম্ভবত তুরস্ক (Britannica)।

চলুন ঘুরে দেখি গোলকুন্ডা দুর্গ।
আমরা ঢুকব প্রধান দূর্গতোরণ বা ফতেহ দরওয়াজা দিয়ে। বাপরে সে কি বিশাল দরজা, মজবুত লোহার ফ্রেমে তৈরি, অসংখ্য লোহার শলাকা গাঁথা, হাতিও মাথা দিয়ে দরজা ভাঙতে পারবে না।এরকম পরপর আটটি মজবুত দরজা পেরিয়ে পৌঁছুতে হত বালাহিসার বা দরবার হলে।মঙ্গলাভরম পাহাড়ের ৫ বর্গ কি:মি: জায়গা জুড়ে তিনধাপে তিনটি প্রাচীর দিয়ে  মজবুত করে নিরাপত্তা বলয় তৈরি হয়েছিল। প্রতিটি দরজায় এবং গ্রানাইট পাথরের দেওয়ালের ফুটো দিয়ে ফুটন্ত তেল এবং গলানো সিসে, শত্রুপক্ষের দিকে ঢেলে দেওয়া হতো।আর প্রাচীরের সঙ্গে সংযুক্ত উঁচু উঁচু গম্বুজ, সেনারা সেখানে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ নজরদারি করছেন, আর প্রাচীরের প্যারাপিটে রাখা সারি সারি কামান। গোলকুন্ডা দুর্গের নিরাপত্তা এতই দুর্ভেদ্য ছিল যে ১৬৮৭ সালে আওরঙ্গজেব ৮ মাস ধরে চেষ্টা করেও গোলকুন্ডা জয় করতে পারেননি। অবশেষে ঘুষ দিয়ে সরণদাজ খান নামক বিশ্বাসঘাতক নিয়োগ করে তিনি রাতের অন্ধকারে গোলকুণ্ডায় প্রবেশ করেন।

১৫১৮ থেকে ১৬৮৭ কুতুবশাহী সুলতানদের সর্বমোট শাসনকাল।প্রথম তিনজন সুলতান তাঁদের ৬২ বছরের শাসন কাল কাটিয়ে দিয়েছিলেন কুতুবশাহী সাম্রাজ্য এবং গোলকুন্ডা দুর্গের নিরাপত্তা সুরক্ষা সুদৃঢ় করার কাজে। আসলে তখন সারা পৃথিবীর রাজা বাদশা, ব্যাবসায়ী, তস্কর, লুটেরা- সবাই লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গোলকুন্ডার পানে।এর কারণও ছিল- সারা পৃথিবীতে তখন একটাই হিরের খনি, গোলকুন্ডার কাছে কল্লুর এ।আর কতসব পৃথিবী বিখ্যাত হিরে এক এক করে বেরোচ্ছে সেই খনি থেকে- "কোহিনুর", পারস্য রাজের রাজমুকুটের "দরিয়া-ই-নূর", মাগ্নিফিসেন্ট " দা হোপ", এবং আরো কত শত।

কুতুবশাহী রাজত্বে বিজ্ঞানের বিশেষ করে শব্দ বিজ্ঞানের অসামান্য উন্নতি হয়েছিল।অসংখ্য ডায়মন্ড কাট গম্বুজ, শব্দের প্রতিধ্বনিকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলত। সেজন্যই আমরা ফতেহ দরওয়াজার নিচে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলে শব্দ বিজ্ঞানের প্রয়োগে দুর্গের সর্বোচ্চ স্থান বালা হিসারে সে শব্দ আরো জোরে শুনতে পাই।এই ডায়মন্ড কাট সিলিংয়ের প্রয়োগ আরো অনেক জায়গায় দেখতে পাবেন। এমন কি সুলতানদের সমাধি ক্ষেত্রের দি গ্রেট মস্ক এ গিয়েও এই শব্দ বিজ্ঞানের প্রয়োগ পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
এছাড়াও দুর্গের জল সরবরাহ ব্যাবস্থা এবং প্রাকৃতিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের অসামান্য প্রয়োগ কৌশল দেখলে চমৎকৃত হতে হয়।
মুসলিম শিয়া সম্রাট আর হিন্দু তেলেগু প্রজাদের মধ্যে কিন্তু অত্যন্ত সু সম্পর্কই ছিল। তবে সেই সময়ে ভারতবর্ষ শুধু নয়, সারা বিশ্বের অন্যতম সেরা বিজয়নগর বা হ্যাম্পি সাম্রাজ্যের উন্নতিকে ধ্বংস করার জন্য দক্ষিণাত্যের সমস্ত সুলতানেরা মিলিতভাবে ১৫৬৫ সালে যে অভিযান চালান, তাতে কুতুব শাহী সম্রাটরাও যোগ দিয়েছিলেন। যাকগে রাজা-রাজার লড়াই তো ভারতবর্ষের ইতিহাসে লেগেই থাকত।

এরপর আসছি কুতুবশাহী রাজবংশের কিছু বিশেষ অবদানের কথায়।
আসছি এই রাজবংশের তৃতীয় সুলতান ইব্রাহিম কুলি কুতুব শাহের কথায়। তৃতীয় সুলতান, দ্বিতীয় সুলতান- তাঁর বড় ভাই জামশিদ কুলি কুতুবের ভয়ে মাত্র তেরো বছর বয়সে দেশান্তরী হয়ে বিজয়নগর রাজ রামা রাওয়ের কাছে আশ্রয় নেন।১৫৪৩ থেকে ১৫৫০ সাল অবধি রামা রাওয়ের কাছে পুত্রবত থেকে সংস্কৃত এবং তেলেগু ভাষা শিক্ষা করেন এবং দুটি ভাষাতেই দক্ষ হয়ে ওঠেন।১৫৫০ সালে দ্বিতীয় সুলতানের সম্ভবত ক্যান্সারে মৃত্যু হলে, উনি তৃতীয় সুলতান হয়ে গোলকুন্ডা ফিরে আসেন। কিন্তু সুলতান ততদিনে তেলেগু ভাষাকে এতই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে একদিকে ৩০ বছর ধরে তিনি সুলতান হয়ে রাজ্যপাট সামলাচ্ছেন, অন্যদিকে আবার রাতের বেলায় রেড়ির তেলের আলোয় চলেছে তাঁর সাহিত্যিক জীবন। "মালকিভাড়ামু" নাম নিয়ে তিনি অসংখ্য , অসামান্য তেলেগু কবিতা রচনা করেছেন। এমন কি তাঁর সভাকবিও  ছিলেন বিখ্যাত তেলেগু কবি 'গঙ্গাধর কবি'। তাঁর প্রজাদের কাছে তিনি ছিলেন তাঁদের প্রিয় " মালিক ইব্রাহিম"। আর কুতুবশাহী রাজবংশের রাজাদের নামই হয়ে গেছিল তেলেগু সুলতান বলে।বর্তমান সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে কেমন আশ্চর্য গল্প কথার মতন শোনাচ্ছে ,তাই না !

ইব্রাহিম কুলি কুতুবের পুত্র কুলি কুতুব শাহ। ওই যে বলে না বাপ কা বেটা, সিপাহী কি ঘোড়া, একদম ঠিক তাই। ছোট থেকে চুপচাপ, একা একা ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ান। আর অবসর সময়ে বাবার মতনই কি সব লিখে যান।দু-একটা উদাহরণ দিচ্ছি-

"পিয়া বাজ পিয়ালা পিয়া যায়না, 
পিয়া বাজ ইয়ক-তিল জিয়া যায়না।"

অথবা: "হামারে সাজন খুশ- নজর বাজ হায়
তো উস দিল মে সাব ইসক কি রাজ হায়।"

ভাবা যায় এক সম্রাটের লেখা এটি! 
১৫৮০ থেকে ১৬১১ সাল অবধি তিনি চতুর্থ কুতুবশাহী সম্রাট হিসাবে গোলকুন্ডা রাজ সামলেছেন, আবার সঙ্গে সঙ্গে উৎকৃষ্ট ডেকানি(দাক্ষিণাত্যের উর্দু, উনিই প্রথম কবি), পারসিক, তেলেগু এবং চোস্ত উর্দুতে রচনা করে চলেছেন একের পর এক কবিতা, শের-সায়ারী ইত্যাদি। উনার রচিত শের-সায়ারীর সংখ্যা কম করে হবে পঞ্চাশ হাজার। 

তখন তিনি মাত্র চোদ্দ বছরের রাজপুত্র। আগেই বলেছি কবিতা লেখা এবং ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে দেখা ছিল তাঁর নেশা।এরকমই একদিন মুসা নদীর পার ধরে আনমনে চলেছেন, দেখলেন যে অনেকেই সেজেগুজে মুসা নদীর ওপর নড়বড়ে কাঠের সেতু পেরিয়ে চলেছে ওপারে।কৌতুহলের বশে কয়েকজন কে প্রশ্ন করে জানলেন যে নদীর উল্টোদিকের স্থানটির নাম যুক্তপুরা। এখানে একটি গ্রাম আছে চিচলাম বলে।এই গ্রামে নাকি এক রূপসী নর্তকী আছেন, অসাধারণ কুঁচিপুড়ি নাচ করেন। কোন মানবীর পক্ষে নাকি সেই স্বর্গীয় নাচ করা সম্ভব নয়। উনি নিশ্চয়ই কোন শাপভ্রষ্টা দেবী, স্থানীয় মন্দিরে আজ সেই দেবী নাচবেন তো এঁরা চলেছেন তাঁর নাচ দেখতে।

কি ভেবে কিশোর রাজপুত্র তাঁদের সঙ্গ নিলেন, পৌঁছলেন নাচের অঙ্গনে।
সেই মেয়ে, নাম তার ভাগ্যমতি, সে তো নিজের ছন্দে নেচেই চলেছেন।বয়স তাঁর এই ২০/২১ হবে, তাঁর কাজল টানা চোখে আগুন, আর বহ্নিশিখার মতন তাঁর সৌন্দর্য। সেই বহ্নি শিখায় ঝলসে গেল ১৪ বছরের রাজপুত্রের মন-প্রাণ।
শুরু হল ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। ভাগমতির নাচ দেখার জন্য আর কোন ব্যক্তির প্রবেশাধিকার রইলো না। এখন থেকে স্রেফ রাজপুত্রের জন্যই ভাগমতি তাঁর মন প্রাণ ঢেলে নাচ করেন আর সেই নাচের ছন্দে, গানের গলায়, রাজপুত্র উন্মাদ প্রায়।


স্বয়ং সুলতান থেকে পাত্র-মিত্র-অমাত্য সবাই ব্যার্থ হলেন রাজপুত্রের এই অভিসার বন্ধ করতে। এমন অবস্থা দাঁড়িয়ে ছিল যে একবার মুসা নদীতে ভয়ঙ্কর বান এসেছে শুনে পাগলের মতন ঘোড়া ছুটিয়ে ভাগ্যমতির কাছে পৌঁছনোর জন্য ঘোড়া শুদ্ধ নদীতে ঝাঁপ দেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। শোনা যায়, এ ঘটনার পরে সুলতান ইব্রাহিম পুত্রের যাতায়াতের জন্য মুসা নদীর ওপর পাথরের তৈরি প্রথম সেতু তৈরি করেন যার নাম পুরানা পুল। এখানে উল্লেখযোগ্য যে রাজপুত্রের মাতাও বিবাহের আগে ছিলেন ভাগীরথী নামক এক হিন্দু নারী।

সুলতান ইব্রাহিমের মৃত্যু হলে ১৫৮০ সালে সিংহাসনে বসেন মহম্মদ কুলি কুতুব শাহ।সুলতান হয়ে তিনি এক অবিশ্বাস্য কাজ করেন। তাঁর পরিবারের, আমীর ওমরাহদের আপত্তি  অগ্রাহ্য করে তাঁর থেকে বয়সে বড়, অসামান্য রূপসী, নৃত্যপটিয়সী ভাগমতি কে বিবাহ করেন।স্ত্রী কে দেওয়া তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার ছিল এক নতুন শহরের পত্তন- ভাগ্যনগর। ভাগমতি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাঁর নাম হয় 'হায়দার মহল' এবং নতুন শহরের নাম হয় হায়দরাবাদ।

কুলি কুতুব শাহের মৃত্যু ঘটলো ১৬১১ সালে। কি আশ্চর্য ঘটনা ভাগমতির ও মৃত্যু হল সে বছরেই।একের বিরহ ব্যাথা অন্যকে বেশিদিন সহ্য করতে হয় নি।

                                 ১ ম সম্রাট কুলি কুতুব শা এবং উনার নাতি সুভান এর সমাধি। ছবি-লেখক।


তারপর কি হলো দেখতে চলুন কুতবশাহী টম্বে। অনেকে এটিকে সাত গম্বুজ মকবরাও বলে থাকেন।
গোলকুন্ডা ফোর্টের বানজারা দরওয়াজা থেকে সামান্য দূরেই অবস্থিত কুতুবশাহী সমাধির অসামান্য কবর সৌধগুলি।জায়গাটির নাম ইব্রাহিম বাগ( ফোর্ট রোড, তলি চৌকি)।মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে থাকবেন এই জায়গাটিতে এলে। কবর স্থানও এত সুন্দর করে, এত যত্ন সহকারে তৈরি হতে পারে! তাজমহলের কথা বাদ দিচ্ছি, সেখানে লোকদেখানো গ্রান্জার বেশি। কিন্তু এখানে এই নিভৃতে-নিরালায় কুতুবশাহী সুলতানেরা তাঁদের জীবিত কালেই তিল তিল করে ইহজন্মের ভালোবাসায় সিক্ত করে তৈরি করেন তাঁদের মৃত্যুর পরের বাসস্থান গুলিকে। ইন্দো-সারাসিনিক রীতিতে নির্মিত এই অসাধারণ সৌধগুলির শিল্প সুষমা না দেখলে বিশ্বাসই হবে না- এগুলি কত সুন্দর! সমাধি, বাগান, মসজিদ, হামাম - ৪০ টি সমাধি, ২৩ টি মসজিদ এবং ৫ টি আলাদা আলাদা দেওয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা এই কপ্লেক্সটির মোট আয়তন ১০৬ একর। এই বিশাল স্থানটিতে সম্রাট এবং তাঁদের বেগমদের সঙ্গে আরো অনেক পরিজন, হাকিমি চিকিৎসক এমন কি সম্রাটের রাজদরবারের নর্তকী বা গায়িকাদের অবধি অনেকের সমাধি আছে। খুব কমজায়গাই এমন আছে যেখানে  রাজবংশের পুরো খানদান এমন ভাবে এক জায়গাতেই সমাহিত রয়েছেন। 
ছোট সমাধির গ্যালারিগুলি দেখছি একতলা এবং বড় সমাধিগুলির দোতলা। সমাধির ডোমগুলি একসময় পারস্য থেকে আনা সবুজ এবং নীলরঙের টালি দিয়ে অলঙ্কৃত ছিল। বর্তমানে তার সামান্য অংশই বেঁচে আছে।

২০১৮ সালে ১০ টাকার প্রবেশমূল্য এবং ২০ টাকা ক্যামেরা চার্জ লাগত এখানে প্রবেশ করতে। এই স্থানটির রক্ষণাবেক্ষণ শুরু হয়েছে আগা খান ট্রাস্ট ফর কালচার এবং টাটা ট্রাস্টের যৌথ উদ্যোগে। মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকেই প্রথমে বাঁ দিকে পড়বে সাইট এক্সিবিশন হল। এখান থেকে বেরিয়ে সামান্য দূরে ডানদিকে চোখে পড়বে কুতুবশাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা বড়ে মালিক বা সুলতান কুলি কুতুব শাহের (রাজত্বকাল ১৫১৮- ১৫৪৩) সমাধি সৌধ।  বিশাল জায়গা জুড়ে, উঁচু ভিতের ওপর অবস্থিত এই অসাধারণ সৌধটি মনে এক অপার্থিব অনুভুতি নিয়ে এলো। সৌধটির বাইরের আয়তন চারদিকে ৩০ মিটার করে, মূল সমাধিগৃহের আয়তন বর্গাকার, ১০ মিটার প্রতি দিক।
সৌধটির অন্দরে তিনটি কবর এবং চাতালে আরো ২১ টি কবর আছে। সুলতানের তিন ধাপে নির্মিত সমাধি বেদির উপরে শুনলাম Naskh এবং Tauq - দুটি বিশেষ ইসলামিক হরফে কিছু লেখা আছে। উনার সমাধির চাতালেই রয়েছে উনার নাতি এবং মাত্র ২ বছরের জন্য সম্রাট বনা জামশিদ পুত্র সুবহান  কুলি কুতুব শাহের সমাধি।

                                                ২য় সম্রাট জামসিদের সমাধি। ছবি-লেখক।

প্রথম সম্রাটের সমাধিটির ঠিক পরেই হচ্ছে উনার পুত্র এবং ঘাতক দ্বিতীয় সুলতান জামশিদ কুলি কুতুবের দোতলা সমাধি( ১৫৪৩-১৫৫০)। এটি তৈরি করেন উনি ১৫৫০ সালে এবং সে বছরই বলা হয় সম্ভবত ক্যান্সারে পিতৃঘাতি সম্রাটের মৃত্যু হয়। 


                                                        ৩য় সম্রাট ইব্রাহিমের সমাধি। 
                                                     ছবি WIKIMEDIA COMMONS. 

এই সমাধি ক্ষেত্রের সর্বপ্রেক্ষা বৃহৎ কবরসৌধটি হচ্ছে ছোটে মালিক বা তৃতীয় সুলতান ইব্রাহিম কুলি কুতুব(১৫৫২-১৫৮০)  বা তেলেগু সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক 'মালকিভাড়ামু'র। এটিও তৈরি হয় উনার মৃত্যুর বছরে-১৫৮০ সালে। এই সমাধি সৌধের মধ্যে দুটি এবং চাতালে আরো ষোলটি পারিবারিক সমাধি আছে। এই সৌধটিতেই দক্ষিণ দেওয়ালে সামান্য পরিমানে নীল সবুজ রঙের আদি এনামেল টাইলস এখনও বেঁচে আছে। মূল সৌধের মধ্যে দুটি এবং বাইরে ১৬ টি কবর দেখা যাচ্ছে। শুনলাম উনার সমাধি বেদির উপরে একটি বিশেষ (Thuluth) ইসলামিক হরফে কিছু লেখা আছে।

চতুর্থ সুলতান মহম্মদ কুলি কুতুব শাহের(১৫৮০-১৬১২) সমাধি সৌধটি সর্বপ্রেক্ষা সুন্দর দর্শন। ১৬০২ সালে নির্মিত প্রেমিক কবির উপযুক্ত সমাধিই বটে। এই সমাধির স্থাপত্যে বিশেষ করে স্তম্ভগুলি এবং লিনটনের কাজের মধ্যে সর্বাধিক হিন্দু স্থাপত্যের প্রভাব চোখে পড়ে। বাইরে এই বর্গাকার সমাধির প্রতিদিকের দৈর্ঘ্য ২২ মিটার করে, ভিতরে এটি প্রতিদিক ১১ মিটার দীর্ঘ। সুলতানের সমাধি কিন্তু টেরেসের নিচে রয়েছে। পারসিক এবং Naskh হরফে অলঙ্কৃত।

                                              চতুর্থ সম্রাট মহম্মদ কুলির সমাধি। ছবি- লেখক।

আরো রয়েছে পঞ্চম সম্রাট বা মহাম্মদ কুতুব শা(১৬১২-১৬২৬) এবং ষষ্ঠ সম্রাট আব্দুল্লাহ কুতুব শা(১৬২৬-১৬৭২)র চমৎকার সমাধি।


                                          ৫ ম সম্রাট মহাম্মদ কুতুবের সমাধি, ছবি- লেখক।


                                              ষষ্ঠ সুলতান আব্দুল্লার সমাধি। ছবি- লেখক।


এখানে উল্লেখযোগ্য যে পঞ্চম সুলতান, হচ্ছেন হায়াৎ বক্সীর স্বামী, কুলি কুতুবের জামাই মহম্মদ কুতুব শাহ এবং উনার পুত্রই হচ্ছেন ষষ্ঠ সুলতান আবদুল্লা কুতুব শাহ। 



                                                    হায়াৎ বক্সী বেগমের সমাধি। ছবি-লেখক।



                                                               দা গ্রেট মস্ক। ছবি- লেখক।

আরো যেসব অসামান্য সমাধি চোখে পড়ল সেগুলি হচ্ছে মহম্মদ কুলি কুতুব শাহ এবং সম্ভবত ভাগমতির একমাত্র কন্যা হায়াৎ বক্সী বেগমের অসাধারন কবর সৌধ এবং সংযুক্ত মসজিদ টি(দি গ্রেট মস্ক)। আরো যেসব সমাধি চোখে পড়লো পঞ্চম সুলতানের ভগিনী ফাতিমা সুলতান, সপ্তম বা শেষ সম্রাট আব্দুল হাসান তানা শাহের অসমাপ্ত সমাধি- চৌখন্ডি ।উনার সমাধিটি অসমাপ্ত কারণ আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দি হয়ে দৌলতাবাদ দুর্গে বন্দি থাকা কালীন উনার মৃত্যু হয় এবং দৌলতাবাদ দুর্গেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। এখানে অবশ্য একটি কবর আছে, যেটি ষষ্ঠ সুলতানের জামাই মির আহমেদের। 
উনার অসমাপ্ত সমাধির প্রাঙ্গনে আরেকটি অসমাপ্ত ছাদ বিহীন কবর আছে, মির আহমেদের স্ত্রী এবং ষষ্ট সুলতান আব্দুল্লা কুতুব শাহের কন্যা ফতিমা খানামের।

কুতুবশাহী পরিবারের সদস্যদের বাইরে যাঁদের সমাধি এখানে দেখা যায় তাঁরা হচ্ছেন ষষ্ঠ সুলতান আবদুল্লা কুতুব শাহের গায়িকা প্রেমিকা তারামতি এবং তারামতির নৃত্যপটিয়সি বোন প্রেমামতির জোড়া সমাধি। আর আছে সুলতান আব্দুল্লার দুজন হাকিমি চিকিৎসক নিজামুদ্দিন আমেদ গিলানী ও আবদুল জব্বর গিলানীর চমৎকার দুটি সমাধি। নেকনাম খান ছিলেন ষষ্ঠ সুলতানের সেনাপতি, উনার সমাধিও এখানেই আছে।
আগেই লিখেছি এই স্থানে সর্বমোট ২৩ টি মজজিদ আছে। প্রায় প্রতিটি সমাধির সঙ্গেই একটি মসজিদ জুড়ে আছে। এদের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর মসজিদ হচ্ছে ১৬৬৬ সালে হায়াৎ বক্সী বেগম দ্বারা নির্মিত দা গ্রেট মাস্ক। এমনকি সম্রাট আওরঙ্গজেব গোলকুন্ডা দুর্গ ধ্বংস করলেও , এই স্থানে একটি ক্ষুদ্র মসজিদ নির্মাণ করেন। বিশাল প্রাঙ্গনের পশ্চিম দিকে রয়েছে সুফি সাধক হুসেন শা-র দরগা। মনে রাখতে হবে আজকের হায়দরাবাদ শহরের অন্যতম মধ্যমনি হুসেন সাগরের নির্মাণ কিন্তু ১৫৬২ সালে এই মহাত্মার হাতেই হয়েছিল।

কিন্তু এত কিছুর মধ্যে ভাগমতি কোথায় ? না কোথাও কুতুবশাহী সমাধির মধ্যে ভাগমতির কোন চিন্হ চোখে পড়লো না। তাঁর স্বামীর সমাধি আছে, মেয়ের সমাধি আছে, এমন কি গায়িকা তারামতি ও নৃত্যপটিয়সি প্রেমামতির অবধি সমাধি আছে, কিন্তু আমরা জানিনা, ভাগমতির মৃত্যুর পরে কোথায় গেল তাঁর মরদেহ ?

ঠিক কি ঘটেছিল তাঁর মরদেহ নিয়ে।ভারতীয় এবং ইসলামিক আর্ট বিশেষজ্ঞ জিয়াউদ্দিন আহমেদ শাকিবের মতে " মীর মোমিন দা পেশোয়া(প্রাইম মিনিস্টার) অফ মহম্মদ কুলী ডিড নট এপ্রিসিয়েট দা ক্লোজনেস বিটুইন দা সুলতান এন্ড ভাগমতি। দেয়ার ফোর, হি ডিসাইডেড টু এনসিওর দেট ভাগমতি'স ক্যারেক্টার ইস ড্রাইভেন আউট অফ কনটেম্পোরারি হিস্ট্রি, সো মাচ সো দেট শি ডিড নট ইভেন হেড এ টম্ব বিল্ট ওভার হার লাস্ট রিমইন্স।"

হায় রে ভাগমতি, হায় রে সম্রাট কুলি কুতুব শাহ।সারা ভারতের আকাশে- বাতাসে অমর হয়ে আছে তোমাদের প্রেমকাহিনী। তোমরা বেঁচে আছো , বেঁচে থাকবে- আমাদের মনে, সংগীতে , লোকগাঁথায়, শিল্পীর কলমে/ছবিতে, নাটকে। কোন নৃশংস উন্মাদের ক্ষমতাও নেই এই অমর প্রেমকথা কে মুছে দিতে পারে।

পরিশিষ্ঠ : না ভুল বললাম, শত শত বছর ধরে চলে আসা প্রেমগাঁথাকে হটাৎ করে নস্যাৎ করে দিয়ে  দুই ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে , রাজনৈতিক খেলায় মেতে উঠেছেন। লড়াইয়ের নির্যাস হচ্ছে , ভাগমতির কোন সমাধি যখন খুঁজে পাওয়া যায়নি, তখন এরকম কোন চরিত্রের অস্তিত্বের কল্পনা করা স্রেফ গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া কিছু নয় , একপক্ষ বলছে ভাগমতি থেকে নয়, ভাগ্যনগর বলতে তখন সৌভাগ্যের নগর বোঝান হয়েছিল। অনেক সেকুলার দল এবং নামি ঐতিহাসিকরা তো এমন সন্দেহও করেন যে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কোন ধর্মীয় সম্প্রদায় ভাগ্যমতির কাহিনী আমদানি করেছিল। শত শত বছর ধরে চলে আসা প্রেমগাঁথা , চারণকবিদের গান, শিল্পীর তুলিতে আঁকা চিত্র কথা সব মিথ্যে। 

অথচ এই প্রেমকাহিনী নিয়ে  কিছুদিন আগেই হায়দরাবাদের বিখ্যাত নাট্যকার মোহাম্মদ আলী বেগ রচনা করেছেন তাঁর বিখ্যাত নাটক-
" Dilon-ka-Shehzaada". 
তিনিও রাজনৈতিক নেতাদের সম্মন্ধে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মন্তব্য করেছেন-" Whether Bhagmati existed or not has no bearing on the name of a city. The controversy is only a part of a clear political agenda. "

২০০৫ সালে বলিউডের ক্লাসিক ছবি Bhagmati- The Queen of Fortunes এ হেমা মালিনীর নাচের সঙ্গে বশির বদরের লিরিক্স, বিশাল ভরদ্বাজের সুরে,  অসাধারণ গান গেয়েছেন রেখা ভরদ্বাজ। এই সিনেমার মেরি জান গানটিকে তো একটি চিরকালীন ক্লাসিক গান বলে অনেকেই বর্ণনা করেছেন -
Meri jan meri
Jan meri jan
Hay dekhna dildar
Taro ki atari mein
Mere naina ke dono
Bat khule hain intezaari mein
Meri jan meri jan meri jan.

সত্য সেলুকাস ! কি বিচিত্র এই দেশ। রোমিও- জুলিয়েট, লায়লা-মজনু সব চিরন্তন প্রেম কাহিনী চিরকাল শাশ্বত প্রেমের বাণী বহন করে এসেছে, একটিও তর্জনী কেউ ওঠায়নি, এই চরিত্রগুলি নিয়ে। বাংলাতেও মনসামঙ্গল কাব্যে বর্ণিত বেহুলা- লখিন্দরের কাহিনী চিরকাল আপামর বাঙালির মনে অমর প্রেমের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। আজ মহাম্মদ কুলী কুতুব ও ভাগ্যমতির প্রেমকথাকে কেন লাশকাটা ঘরে নিয়ে গিয়ে ইতিহাসের আতস কাঁচের নীচে কাটা-ছেঁঁড়ার দরকার পড়ল জানিনা।

এও জানিনা রাজনীতির কারবারিদের কি অধিকার আছে যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রেম ও বিশ্বাসের উপর, ধর্মীয় কুঠারের দ্বারা আঘাত করার। যদি কুলি কুতুব আর ভাগমতি/হায়দারি বেগমের কাহিনীর কোন অস্তিত্ব নেই, তবে গোলকুণ্ডা ফোর্টের লাইট এন্ড সাউন্ড অনুষ্ঠানে কেন বলিউডের খানদানি অভিনেতাদের ব্যারিটন ভয়েসে এই কাহিনী শোনান হয় ? 
দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে যেসব যুক্তিবাদী লোক একদা রানী ভাগমতিকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন, তাঁরাও অকস্মাৎ নিজেদের অবস্থান বদলে নামি দামি ব্লগ থেকে নিজেদের আগের লেখাগুলি উঠিয়ে নিয়েছেন। কিছুদিন আগেও যে লেখাগুলি জ্বল জ্বল করে শোভা পাচ্ছিল, আজ সেই লেখাগুলি আর খুঁজে পেলাম না। 
হায়দরাবাদ শহরে, অন্ধ্র প্রদেশ মিউজিয়াম অফ আর্ট, যদি ঘুরে দেখেন তবে রানী ভাগমতির প্রচুর পেইন্টিং চোখে পড়বে, এর মধ্যে একটি অষ্টাদশ শতকে আঁকা ছবিও আছে ।

ভাগ্যমতির ট্র্যাজিক ভাগ্য নিয়ে একটি অসাধারণ লেখা পড়লাম সোহেল হাশমির-" The love story of Quli Qutub and Bhagmati, and other tragic endings. " 

ভাগ্যমতির নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য দুই সম্প্রদায় কিভাবে সমবেত ভাবে চেষ্টা করেছে, চমৎকার বিশ্লেষণ করে দেখান হয়েছে এতে। একজন নাচনেওয়ালি বেগম হয়েছেন, তাঁর নাম থেকেই পরবর্তী কালে প্রথমে ভাগ্যনগর এবং পরে হায়দরাবাদ শহরের নাম হয়েছে , এতে সম্রাট কুলি কুতুব শা-র কোন অসুবিধা না থাকলেও, আধুনিক যুগে দুই সম্প্রদায়ের হজম করে মুশকিল হয়ে গেছে। তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে আধুনিক মনস্ক পন্ডিতেরা যেমন ভাগ্যমতির অস্তিত্বই অস্বীকার করেন, তেমনি জানা গেল সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ও রাতারাতি (১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি) চারমিনারের একটি স্তম্ভের মধ্যে ভাগ্যলক্ষ্মী বলে এক কাল্পনিক দেবীর মূর্তি বসিয়ে দিয়ে শেষমেশ একটা মন্দির অবধি বানিয়ে ফেললো। রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার, এ এস আই কেউ দেখেও দেখলো না। দাবি উঠল দেবী ভাগ্যলক্ষ্মী হচ্ছেন প্রাচীন এক দেবী, উনার নাম থেকেই শহরের নাম হয়েছিল- ভাগ্যনগর। দুই যুযুধ‍্যমান পক্ষই ভাগমতিকে অস্বীকার করল। এই সুযোগে অনেক পন্ডিত ও ঐতিহাসিক ভাগমতিকে বোল্ড আউট করতে, শেষ অবধি দেবীর গল্পকেই লুফে নিল। 

 Soyel Hashmi র মূল্যবান লেখাটির শেষ লাইন উদ্ধৃত করে আমার বক্তব্য শেষ করছি- 
" And so this is another love story that has been vitiated by those who thrive on hate."



তথ্যসূত্র:- 1. Hyderabad History-Old Kingdoms to modern times.Illustrated with Maps & Photos. hyderabadPlanet.com

2) Ishq Namah : Banaam Quli Qutub Shah- Urdu Shayari I https:/ blog.rekhta.org

3) The love story of Quli Qutub and Bhagmati, and other tragic endings. Sohail Hashmi.( First published in Terrascape.)
https:// kafila.online>2013/03/04





5) History of Hyderabad. Wikipedia.

6) হায়াৎ বক্সী বেগম যে ভাগমতির কন্যা এই তথ্যটি পেয়েছিলাম স্থানীয় গাইড এবং  Absorbing Love story of Rani Bhagmati who married the Sultan of Golconda. লেখাটিতে। 




7) For Hyderabad, Bhagmati is vital part of history. Mir Ayoob Ali Khan l TNN  I Mar 22, 2010.

Friday, July 24, 2020

                                                    মনসামঙ্গল কাব্যের সেকাল-একাল।

                                                           সেকাল-( প্রথম পরিচ্ছদ ) ।


সপ্তাহান্তের ছুটিতে টাইম মেশিনে চেপে চলুন সেকালের মঙ্গলকাব্যের চাঁদ বণিকের খোঁজে, বেহুলা লখিন্দরের অমর প্রেমের সন্ধানে , একালের কসবা চম্পাইনগর, পানাগড় , পূর্ব বর্ধমানে। কিন্তু সেজন্য মনসামঙ্গল কাব্য নিয়ে কিছু জানা থাকলে রসাস্বাদন করতে মনে হয় সুবিধা হবে। তাই ছোট করে মনসামঙ্গল নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

মনসা মাতার পূজা ।

মনসামঙ্গলের কাহিনী সর্বজনবিদিত। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সম্ভবত প্রাচীনতম মঙ্গলকাব্য এটি। অসংখ্য রচনাকার যুগে যুগে বিভিন্ন আঙ্গিকে, স্থানীয় ভৌগোলিক এবং লৌকিক কাহিনী এবং অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে মনসামঙ্গল রচনা করেছেন।প্রথম রচনাকার কানাহরি দত্ত থেকে শুরু করে পূর্ববঙ্গের বিজয় গুপ্ত(রচনাকাল ১৪৯৪), বিজয় গুপ্তের সমসাময়িক নারায়ণ দেব কিংবা তার ঠিক পরেই রাঢ় বঙ্গের বিপ্রদাস পিপলাই(রচনা ১৪৯৫) যাঁর 'মনসা বিজয়' সেযুগে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি যে কানাহরি দত্ত তার প্রমান পাই বিজয় গুপ্তর  "পদ্মাপুরান" গ্রন্থে।
"সর্বলোকে গীত গাহে না জানে মাহাত্ম্য।
প্রথমে রচিল গীত কানাহরি দত্ত।।"

এরপরে জনৈক কেতকাদাস(অর্থাৎ কেতকা বা মা মনসার দাস) ক্ষেমানন্দের রচিত মনসামঙ্গল ( ১৭২৯) ও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। এমন কি আধুনিক যুগেও জরুরী অবস্থার সময় বিশিষ্ট নাট্যকার শম্ভু মিত্র মনসামঙ্গল অবলম্বনে রচনা করেন এক অসাধারণ নাটক ' চাঁদ বণিকের পালা'। এতোগুলো মনসামঙ্গল থেকে বেছে নিচ্ছি কবি বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরান গ্রন্থটি। সেখানে শুরুতেই লেখা আছে দেখছি-

নেতা বলে বিষহরি হেথা রহিয়া কিবা করি

মর্তভূমে চলো যাই।

মর্ত্য ভুবনে যাইয়া ছাগ মহিষ বলি খাইয়া

সেবকেরে বর দিতে চাই।।

এখানে বলার কথা যে নেতা ও মনসা দুজনেই শিবের কন্যা।


মনসার মূর্তি ।

'আইলে মনসা দেবী না করি বিচার।

ঊনকোটি নাগ লইয়া দিলা পাটয়ার।।

রত্নময় সিংহাসনে বসিলা বিষহরি।

বাম পাশে বসে নেতা রজক কুমারী।।

এর পরেই কি লেখা আছে পড়ুন-


ক্ষীর নদী হইতে উঠে গড়লের ফনা

মুখ হইতে পড়ে বিষ যেন অগ্নিকনা।।

এটুকু পড়েই বোঝা যাচ্ছে যে মনসাকে ঠিক আর্য দেব-দেবীর ধাঁচে ফেলা যাবে না।তিনি হচ্ছেন এক অসাধারণ অনার্য লৌকিক দেবী যিনি আমাদের মতন সাধারণ মর্তবাসীদের সাবধান করছেন এই বলে-

অহঙ্কারে মোর গীত করে উপহাস।

মোর কোপে হবে তার সবংশে বিনাশ।।

নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার করে বলুন তো, এই কথাগুলো কি ঠিক দেবী সুলভ অভয়বানি বলে মনে হচ্ছে ?
পুরান আশ্রিত মনসা দেবী কশ্যপ ঋষির কন্যা, কিন্তু মঙ্গলকাব্যগুলিতে তাঁকে শিবের কন্যা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। মনসা সাপের দেবী কিন্তু পৌরাণিক চরিত্র কিনা সন্দেহ আছে, তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক দেবী রূপে প্রতিষ্টা করার জন্যই পুরানের অবতারণা করা হয়েছে। 
পদ্মপুরান, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান এবং দেবী ভাগবতে মনসার উল্লেখ আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে মনসার উৎপত্তি বলা হয়েছে কশ্যপ মুনির মন থেকে। " কন্যা সা চ ভগবতী কশ্যপস‍্য‍ চ মানসী।তেনেয়ং মনসা দেবী মনসা যা চ দীব্যতি।।"

আসলে মনসার জন্ম বৃত্তান্ত বেশ অদ্ভুত। শিবের ঔরসে মনসার জন্ম, কিন্তু কোন জননীর গর্ভে তিনি জন্মাননি। মা না থাকায় স্বভাবত তিনি হয়ে উঠেছেন জেদী এবং উদ্ধত।অনেক আবদার করে পিতাকে সম্মত করান বিমাতা পার্বতীর কাছে যাবার জন্য। কিন্তু ভুলবশত পার্বতী মনসাকে তাঁর সতীন মনে করে কুশ দিয়ে তাঁর এক চোখ কানা করে দেন।মনসা তৎক্ষণাৎ পার্বতীকে দংশন করে মেরেই ফেলেন।

"চন্ডীর প্রহার আর সহিতে না পারি।
দেব মূর্তি এড়িয়া পদ্মা নাগ মূর্তি ধরি।"

এর পর কি হোল-

"অতি কোপে পদ্মাবতী করে ধড়ফড়।
চন্ডীর হৃদয়ে দিল বজ্র কামড়।।"


পরে পিতার অনুরোধে বিষ হরণ করে আবার জীবিত করে তোলেন।

এমন কি বিষ পান করে নীলকণ্ঠ শিব যখন অচৈতন্য প্রায়, তখন শিবের এই হতভাগ্য কন্যাই তাঁকে বাঁচিয়ে তোলেন।

"ধ্যান করিয়া বসে দেবী বিষহরী।

পদ্মা বলে বাপ তুমি দেব-অধিকারী।।

কর্ণে মন্ত্র পড়িয়া দেবী বলে উঠ উঠ।

মুখ বাহিয়া বিষ পড়ে ফুট ফুট।।

বুকে হাত দিয়া পদ্মা জপে মহাজ্ঞান।

গা মোড়া দিয়া শিব উঠিল বিদ্যমান।।"

মনসার নাম গান বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে সাধারণত পালাগান এবং কখনও কখনও যাত্রাপালার মাধ্যমে রাতের বেলা পরিবেশিত হতো।একে তো নদীমাতৃক বাংলাদেশে সাপখোপের উপদ্রব এমনিতেই বেশি ছিল, তারমধ্যে রাত্রি বেলায় হ্যারিকেনের আলোয় পালাগানের মধ্যে দিয়ে সবাই শুনছে চাঁদ সওদাগরের একে একে ছয় পুত্র, বন্ধু শঙ্কর, এমনকি অনিরুদ্ধ রুপী ছোট পুত্র লখিন্দরও বাসরঘরে সাপের কামড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে- কি ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসা ও মৃত্যুর মহামিছিলের কাহিনী।আর সত্যি সত্যিই তো তখন সাপের কামড়ের কোন চিকিৎসা নেই, ওঝার ঝাঁড় ফুঁক ছাড়া।তাই মৃত্যু অবধারিতই ছিল- সে বিষেই হোক বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েই হোক।কাজেই গ্রামগঞ্জের এই সহজ সরল লোকগুলি ভয়েই হোক বা ভক্তিতে, মনসা পালায় বিগলিত হয়ে যেতই। কোথাও সেই পালার নাম ছিল বিষহরির গান, কোথাও রয়ানী গান, আবার কোথাও মনসার টপযাত্রা।

মনসামঙ্গল কাব্য সোজাসুজি দুটি পর্বে বিভক্ত। একটিকে বলা যেতে পারে দেব-কথা।এখানে মুখ্য চরিত্র হচ্ছেন মনসা দেবী স্বয়ং। ছলে, বলে, কৌশলে তিনি ব্যস্ত তাঁর দেবত্ব জাহির করতে।অন্য পর্বটিকে বলা যেতে পারে মনুষ্য কথা।এই মনুষ্য কথা আবর্তিত হচ্ছে তিনটি অসাধারণ চরিত্র নিয়ে- চাঁদ বণিক, বেহুলা ও লখিন্দর কে ঘিরে। এবং তিনটি মানব চরিত্রই তাঁদের মানবিক চরিত্রের গুনে অতিশয় সমুজ্জ্বল। 

এবার আসি চাঁদ বণিকের কথায়। চাঁদ কোন ভয়ঙ্কর মানুষ নন।তিনি স্ত্রী পুত্রদের নিয়ে ঘোরতর সংসারী। আবার তিনি দেবাদিদেব মহাদেবের পরম ভক্ত এবং কোন অবস্থায়ই ধর্ম চ্যুত্য হতে রাজি নন।শত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও হার-না-মানা তাঁর স্বভাব।তিনি কারো কোন ক্ষতি করেন নি , তবুও তাঁর ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অন্যের হাতে, অন্যের খামখেয়ালিতে এবং দুঃখের বিষয় সেই নিয়ন্ত্রক একজন দেবী যিনি মর্তলোকে পূজা পাবার জন্য চাঁদের বন্ধু শঙ্কুর গাড়রীকে(গড়ুর সাপের শত্রু, অর্থাৎ বিষ চিকিৎসক)বধ করেন। চাঁদকে নির্বংশ করেন, তাঁর বাণিজ্য তরী চৌদ্দডিঙ্গা মধুকর ডুবিয়ে দিয়ে নি:স্ব করেন।

এখানেই না থেমে-"নাগকন্যা একজাতি, সঙ্গে নাগ উনকোটি, নন্দনবাড়ী করিল ছারখার।" এমন কি- ধরিত্রী মাতাকেও আঘাত করতে ছাড়লেন না।

"যত যত বৃক্ষ ছিল, এক গোটা না থুইল,
প্রহরী সব করিল সংহার।"

 তবুও চাঁদ না দমলে শেষমেশ স্বর্গের ঊষা ও অনিরুদ্ধ কে পাঠালেন মর্ত্যলোকে, চাঁদকে বশ করার জন্য। কিন্তু এখান থেকেই প্রতিহিংসার গল্প ঘুরে গেল।তৈরী হলো বাঙালির কালজয়ী ভালোবাসার - বেহুলা-লখিন্দরের গল্প, যার তুল্যমূল্য গল্প বিশ্ব সাহিত্যেও বিরল। "কালকেউটের ফনায় নাচছে লখিন্দরের স্মৃতি/ বেহুলা কখনো বিধবা হয়না, এইবাংলার রীতি।" 

কালকেউটের ফনায় নাচছে লখিন্দরের স্মৃতি,
বেহুলা কখনো বিধবা হয়না, এইবাংলার রীতি।
এখন কথা হচ্ছে যে চাঁদ সওদাগর একটি লৌকিক চরিত্র তবুও চম্পাইনগর বা চাঁদ বণিকের পূজিত শিবমন্দির নিয়ে অনেক আলোচনা ও বিতর্ক আছে।কারো মতে এটি পূর্ব বর্ধমানের মানকরের কাছে কসবা-চম্পাইনগর গ্রামে, আবার অনেকে বলেন এর অবস্থান বাংলাদেশের বগুড়ার কাছে গোকুলমেধ নামক স্থানে। এরকম আরো অনেক দাবিদার আছেন। তাই চলুন চম্পাইনগরের ভৌগোলিক অবস্থান বুঝবার চেষ্টা করি। ঋদ্ধি পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় শ্রীঅনির্বান ভট্টাচার্য এই নিয়ে বিশদ লিখেছেন। তাঁর মতে- অঙ্গদেশ বলতে বোঝাত ' ভাগলপুর, সাঁওতাল পরগনা, ধানবাদ, মালদহ, বীরভূম এবং বর্ধমানের এক বিস্তীর্ণ এলাকা।' অর্থাৎ ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখতে পাচ্ছি, মঙ্গলকাব্যের রচনাকালের সমসাময়িক সময় ১৪৯৩ সালে বাংলার মসনদে আসীন হন সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এবং তিনি বিহারের বিস্তীর্ণ অংশ জয় করে বাংলার সঙ্গে জুড়ে দেন।

সেই সময় গঙ্গা বা ভাগীরথীর তিনটি ধারার মধ্যে প্রধান(আদি গঙ্গা) ধারাটি বিস্তৃত ছিল ত্রিবেণী অবধি , এবং ভাগীরথীর আরো দুটি ধারা বা শাখানদী ছিল যমুনা ও সরস্বতী। এই তিনটি ধারার সঙ্গমেই অবস্থিত ছিল সেকালের বিখ্যাত বন্দর ও বাণিজ্য নগরী সপ্তগ্রাম। আদি গঙ্গার মধ্য দিয়েই বাণিজ্য তরী নিয়ে বনিকেরা বহির্বিশ্বে যাতায়াত করতেন যার মধ্যে চাঁদ সওদাগরের চৌদ্দ ডিঙ্গা ( পদ্ম পুরাণের চৌদ্দডিঙ্গা- চন্দ্ররেখা, সিংহমুখ,গরুড় মহারথী, শঙ্কুচর, সুমন্ত বহাল, সমুদ্র উথাল, গৌরাঙ্গ, মগর, ধুতুরার ফুল, মঙ্গলা, চন্দ্রপাট, সিন্দুর কটুয়া, হাসমড়া এবং মধুকর) হয়ত ছিল।মধ্য যুগে ব্যাবসা বাণিজ্য চলত বিনিময় প্রথায় " কলাই দেখিয়া রাজার আনন্দ বিশাল।ইহার বদলে দিল মুক্ত প্রবাল" । আবার কড়ি প্রথাও চালু ছিল। যেমন বিজয় গুপ্তের লেখায় পাচ্ছি-                                                           " একপন করি দিয়া  ক্ষৌরশুদ্ধি হবে।                                                                                                আর একপন কড়ি দিয়া চিড়া কলা খাব।।
আর একপন করি দিয়া নটি বাড়ি যাব।
আর একপন কড়ি নিয়া সোনেকারে দিব।। "

বিপ্রদাস পিপলাই বিরচিত মনসামঙ্গলে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য তরী কোন পথে যাতায়াত করত সেই বর্ণনা দেওয়া আছে। চাঁদের ডিঙ্গা সপ্তগ্রাম বন্দর/ত্রিবেণী হয়ে সমুদ্রপথে গমন করত। শ্রদ্ধেয় নিহাররঞ্জন রায়ের বাংলার ইতিহাস, আদি পর্ব( প্রথম প্রকাশন ১৯৭২, পুনর্মুদ্রণ ২০০৫, পৃষ্টা ৭৫, দেজ পাবলিশিং, ১৩, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা), এই পথটিকেই সমর্থন করে। সুতরাং গাঙ্গুর নদী, ত্রিবেণী, সপ্তগ্রাম সব মিলিয়ে পূর্ব বর্ধমানের কসবা, রণডিহার মধ্যে অবস্থিত চম্পাইনগর গ্রামই চাঁদ সওদাগরের বাসস্থান হবার সর্বপ্রেক্ষা শক্তিশালী দাবিদার।

এখন কথা হচ্ছে রণডিহার কাছে তো গঙ্গা নয়, দামোদর বইছে। আসলে প্রাচীন দামোদর নদের প্রধান ধারাটি বর্ধমানের কাছে পূবমুখী হয়ে ভাগীরথীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিল।আর দামোদরের দুটি প্রধান শাখা নদী ছিল গাঙ্গুর ও বেহুলা। ১৫৬১ র নাস্টালডির মানচিত্রে বেহুলা ও গাঙ্গুরের খাতকেই দামোদরের মুখ্য জলধারা বলে চিহ্নিতকরণ হয়েছিল(অনির্বান ভট্টাচার্য)। লখিন্দরের শব নিয়ে বেহুলার মান্দাস গাঙ্গুর ও বেহুলার মিলিত জলধারার মধ্য দিয়েই ভেসে গেছিলো এবং পৌঁছেছিল ত্রিবেণীতে। কালপ্রবাহে দামোদরের মূলধারার জল শুকিয়ে যায়, নাম হয় কানা দামোদর। এর সঙ্গে শুকিয়ে যায় বা মজে যেতে থাকে মনসামঙ্গলের গাঙ্গুর ও বেহুলা নদী।যদিও কসবা চম্পাইনগরে এখনও শীর্ণকায়া গাঙ্গুরের সাক্ষাৎ মেলে।


মনসামঙ্গল কাব্যের একাল- চাঁদ-বণিকের দেশে। দ্বিতীয় পরিচ্ছদ।



তাই সপ্তাহান্তের ছুটিতে টাইম মেশিনে চেপে চলুন সেকালের মঙ্গলকাব্যের চাঁদ বণিকের খোঁজে, বেহুলা লখিন্দরের অমর প্রেমের সন্ধানে , একালের কসবা চম্পাইনগর, পানাগড় , পূর্ব বর্ধমানে।

 পূর্ব রেলের বর্ধমানের পরে, দুর্গাপুরের আগে পানাগড় এক উল্লেখযোগ্য জায়গা। এর গুরুত্ব আরো বেশি সেনা ছাউনির জন্য।পানাগর স্টেশনে নেমে হেঁটেই চলে আসুন পানাগড় বাজার। অথবা কলকাতা থেকে  বাসেও আসতে পারেন। আগে বাসগুলি পানাগড় বাজার দিয়েই আসতো, এখন ব্রীজের ওপর দিয়ে চলে যায়। কন্ডাক্টর কে বলে বুদবুদ বাইপাস মোড়ে নেমে যে কোন লোকাল বাসে চলে আসুন পানাগড় বাজার মোড়ে। জি টি রোড থেকে চাঁদ সওদাগরের নিবাস চম্পাইনগর যাবার বাস পাবেন, দুর্গাপুর/বেনাচিতি/আসানসোল - কসবা লেখা থাকবে।এছাড়া সামান্য কিছু ট্রেকার, ভটভটি রিকশা, টোটোও যাতায়াত করে এই পথে। পানাগড় বাজার থেকে প্রথম ৩/৪ কিমি রাস্তার হাল খুব খারাপ।তারপর অবশ্য রাস্তা মোটামুটি ভালোই।কসবায় নেমে সামান্য হাঁটতে হবে চাঁদ বণিকের ঠিকানা চম্পাইনগর যাবার জন্য। লাল মোরাম বিছানো এই সুন্দর মাটির রাস্তাটি আপনার মন ভালো করে দেবে।দুধারে গাঢ় সবুজ রঙের গাছ পালা ও চাষের জমি, মধ্যে মধ্যে ঘন ও দীর্ঘ কাশঝোপ, সারা রাস্তা কত জানা অজানা পাখির কল কাকলিতে মুখর।মোলাকাত হবে মনসামঙ্গলে বর্ণিত গাঙ্গুর নদীর সঙ্গে।এই সেই গাঙ্গুর নদী, যাঁর মধ্য দিয়ে চলাচল করত, সপ্তডিঙ্গা মধুকর।আজ বয়সের ভারে গাঙ্গুর শীর্ণকায়া, নালার রূপ ধারণ করেছে। আপনার গলায় সুর থাক বা না থাক, পথ চলতে চলতে আপনার মন বলে উঠবে- গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে ! হঠাৎ করে ডানদিকে চোখে পড়বে এক বিশালকায় বট বৃক্ষ।অসংখ্য ডালপালা ছড়িয়ে বিরাট জায়গা জুড়ে তার রাজত্ব।বটগাছের মধ্য দিয়েই দেখা যাচ্ছে একটি টিলা ও টিলার মাথায় এক মন্দির।কি অসাধারণ শান্ত নিঝুম পরিবেশ। বট গাছটি যেন যুগ যুগান্ত ধরে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে মন্দিরটিকে। দেখেই ভালো লেগে গেল জায়গাটি। ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে টিলার গা বেয়ে মন্দিরে। পৌঁছুলাম সিঁড়ি বেয়ে টিলার চূড়ার মন্দিরে।

চাঁদ বনিকের শিবমন্দির ।

আরে! এ যে এক বিশাল শিবমন্দির। মন্দিরের মধ্যের শিবলিঙ্গটি কি বিশাল আকৃতির, আর কি সুন্দর দেখতে।

চাঁদ সওদাগরের পূজিত শিবলিঙ্গ ।
মন্দির চত্বরের মধ্যেই আছে আরেকটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র শিবলিঙ্গ, সামনে নন্দী উপবিষ্ট।মন্দির গাত্রে এই দুই শিব লিঙ্গের পরিচয় দেওয়া আছে শ্রী শ্রী রামেশ্বরজিউ ও বানেশ্বরজিউ বলে।বুঝতে পারলাম পৌঁছে গেছি অভীষ্ট স্থানে, এই সেই চাঁদ সওদাগরের প্রতিষ্ঠিত শিব মন্দির ও শিব লিঙ্গ। তবে মন্দিরের প্রাচীনত্ব নষ্ট হয়ে গেছে।মন্দিরটিকে দ্বিতীয়বার সংস্কার করা হয় ২০০৬ সালে। প্রাচীন মন্দিরকে বাঁচাতে গিয়ে আধুনিক রূপদান বেদনাদায়ক। হয়ত এছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না। সে যাকগে ! দর্শন তো হলো।


চম্পাইনগরের প্রাচীন মনসা মন্দির ।

পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভর দুপুর, মন্দির প্রায় শুনশান। পুরোহিত মশাই গেছেন দ্বিপ্রহরের ভোজনে। তবে এক বিয়ের পার্টি বসে আছে, পুরোহিত এলে শুভকর্ম শুরু হবে।

নিচে নেমে , এক হালকা ঝোপ পেরিয়ে এলাম এক ভগ্ন পাথরের কাছে।আমার সঙ্গে আছেন স্থানীয় ভরতপুর গ্রামের তরুণ গাইড শ্রী রণজিৎ রুইদাস(৯৯৩২৬৯০৬৭২)। ওঁর কাছে শুনলাম যে এই পাথরটির নাম স্থানীয়দের কাছে" মাথা কাটা শিব"।

মাথা কাটা শিব ।
কেন এই নাম এ নিয়ে গাইডের কাছে এক প্রচলিত কথা শুনলাম। চাঁদ সওদাগর প্রাণ মনে শিবের ভক্ত। আর সেই শিবঠাকুড়ই কিনা চাঁদকে এমন কথা বলছেন- "কি দরকার বাপু ওই খেপির সঙ্গে বিবাদ জিয়ে রাখার, তোমার তো কত ক্ষতি করেছে, আরো কত করবে তার ঠিক কি! করো না বাপু একটি বারের জন্য নম নম করে ওর পুজো।"

চাঁদ প্রথমে স্তম্ভিত পরে ক্রুদ্ধ, যাঁকে ছাড়া জীবনে অন্য কারো পুজো করেননি, সেই প্রভুর মুখে একি কথা ? ক্রুদ্ধ চাঁদ দণ্ডের আঘাতে শিবলিঙ্গের মতন দেখতে এই পাথরটিকে ভেঙে ফেলেন। তাই এই ভগ্ন পাথরটির লৌকিক নাম হয়, মাথা কাটা শিব। মাথা কাটা শিবের সামনেই এক মা মনসা মন্দির। আর এখান থেকে কাশের ঝোপ সড়িয়ে সামান্য গিয়েই ডানদিকে পড়লো এক অতি প্রাচীন চমৎকার টেরাকোটার মন্দির।

প্রাচীন টেরাকোটার মন্দির ।

কবেকার মন্দির, কোন দেবতার মন্দির, কে প্রতিষ্ঠা করেন, জনে জনে জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পেলাম না। তবে এখনও কি চমৎকার কিছু টেরাকোটা ফলক বেঁচে আছে।রাধা কৃষ্ণের যুগল টেরাকোটার ফলকটি দেখে হয়ত প্রাচীন মন্দিরের গর্ভ গৃহে কেউ হাল আমলের রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তি রেখে দিয়েছেন। এই মন্দিরের বিপরীতে ৫০ ফুট মতন দূরে, চম্পাইনগরের পায়ে চলার পথের ঠিক নীচে এক অতি প্রাচীন সম্ভবত চার চালা মনসা মন্দির- ধুলিস্মাৎ হবার দিন গুনছে।সম্ভবত শব্দ ব্যবহার করলাম কারণ মন্দিরের ছাদে এত আগাছা জন্মেছে যে, ঠিক করে বোঝাও যাচ্ছে না, চার চালার ওপরেও আরো চালা ছিল কিনা।আশ্চর্যের ব্যাপার, প্রাচীন মন্দিরের সংস্কার না করে এর সামনেই একটি আধুনিক মনসা মন্দির প্রতিষ্টা করা হয়েছে।

কাকতলীয় ভাবে প্রাচীন মনসা মন্দিরের ভাঙা দেওয়ালের মধ্য থেকে একটি সাপ বেরিয়ে এসে, বিদ্যুৎ গতিতে ধানজমির মধ্যে লুকিয়ে পড়লো। আমরা নির্ঘাত ওদের শান্ত জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছি।

চাঁদ বণিকের ছয়টি পুত্রকে মনসা হত্যা করেন এ-গল্প তো সবারই জানা। শেষ পুত্র লখিন্দর ও তাঁর সদ্যবিবাহিতা পত্নী বেহুলাকে সাপের কামড়ের হাত থেকে বাঁচাতে যে লৌহনির্মিত বাসর ঘর তৈরি করিয়েছিলেন চাঁদ সওদাগর, সেটিও সকলেরই জানা। আমরা এখন চলেছি সেই বাসর ঘরের দিকে। অবশ্য বাস্তবের এই বাসর ঘর মৃত্তিকা এবং ইষ্টক নির্মিত।ধাপে ধাপে চড়ছি এক নাতিউচ্চ টিলার ওপর। চতুর্দিকে অসংখ্য প্রাচীন, বৃহদাকার ইঁট যত্র তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।কোন কোনটি তার ১৬" × ১০" চওড়া। বেশিরভাগ ইঁটের রঙ লাল তবে বেশ কিছু কালো রঙের ইঁটও চোখে পড়ল।আসলে আমরা বাসর ঘরের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছি।টিলার টঙেই সতী বেহুলার মন্দির। মন্দিরে বেহুলা-লখিন্দর, চাঁদ সওদাগর এবং মনসা দেবীর মাটির মূর্তি রাখা। মন্দিরের সামনে ডানদিকে আছে এক বিশাল শিলপাটা। এখানে আপনাদের অবগতির জন্য জানাই যে, রাঢ়বঙ্গের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শিলনোড়া কিন্তু মা ষষ্ঠীর রূপক এবং সদ্য বিবাহিতা নারীর হাতে অনেক জায়গায় নোড়া ধরানো হয়, ষষ্ঠী ঠাকরুনের কৃপায় বধূ যেন সন্তানবতী হয় এই কামনায়।শুনলাম যে এখনও অনেক নববধূ এই শীল পাটা স্পর্শ করে যায়।


টঙ্গের উপরে বাসর ঘর ।

এই অতি প্রাচীন ইঁট গুলি দেখে, চিন্তা ভাবনা সব যেন কেমন গুলিয়ে যেতে লাগলো। মনসামঙ্গল যদি কেবলই লৌকিক কাব্য হয় তবে এই বৃহৎ ইঁটের ঢিবি, গাঙ্গুর নদী, বিশালকায় শিবলিঙ্গ- এগুলি তো ঘোর বাস্তব। তাহলে কি যুগ যুগ ধরে প্রচলিত অলৌকিক কাহিনী আর বিশ্বাস আদতে বাস্তবের জমির মধ্যেই প্রোথিত ছিল ? 

যদিও কিছটা প্রক্ষিপ্ত ঘটনা, তবুও আরেক বিস্ময় চোখে পড়লো বাসর ঘরের সামান্য দূরে। বিশাল বিশাল ইঁট ও চুন সুরকির গাঁথনীর প্রাচীন চৌবাচ্চা। এরকম চৌবাচ্চা অজয়ের ধারে আগেও দেখেছি। তাই দেখেই চিনতে পারলাম যে এই বিশাল চৌবাচ্চায় নীল গাছ ভেজান ও ফোটান হতো। আদতে এটি একটি প্রাচীন নীলকুঠি। বন্ধুবর এবং বিশিষ্ট ক্ষেত্র সমীক্ষক শ্রী প্রণব ভট্টাচার্য এবিষয়ে অনেক আলোকপাত করেছেন। একদা দামোদর এবং গাঙ্গুরের পতিত জমিতে প্রচুর নীল চাষ হতো। সেই সব নীল রপ্তানি করবার জন্য কসবা গ্রামের পাস দিয়েই , সিলামপুর থেকে সম্ভবত বর্ধমান অবধি ন্যারো গজ রেললাইন দিয়ে মালগাড়ি চলতো।বছর ২০ আগেও সেই রেল লাইনের কিছু কিছু অংশ দেখা যেত।১৮৬২ সালের নীল বিদ্রোহের অন্তে কুখ্যাত নীল চাষ আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। তাহলেই ভাবুন চম্পাইনগর বেড়াতে এসে আপনি প্রত্যক্ষ করতে পারবেন কম করে ১৮৬২ সালের আগের ইতিহাসের এক অধ্যায়।

ইংরেজ আমলের নীলকুটি । 
চাঁদ বণিকের দেশে কষ্ট করে বেড়াতে এলে কিন্তু আখেরে পুষিয়ে যাবে। বিশেষ করে শীতকালে এলে।এখান থেকে অতি সামান্য দূরে দামোদর নদের ধারে আছে , এক চমৎকার বেড়ানোর জায়গা - রণডিহা। আর যাতায়াতের রাস্তায় পড়বে ভরতপুর নামক এক ঐতিহাসিক  স্থান। 

ভরতপুর স্তূপ ।
এখানে অবশ্যই নামবেন এবং দেখবেন এক অসামান্য ঐতিহাসিক মূল্যের সম্ভবত খ্রিস্টীয় দ্বাদশ/ত্রয়োদশ শতক অবধি অধিবসতির সাক্ষ্য স্বরূপ, কুষান স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত বৌদ্ধ স্তূপ। ১৯৭১ ও ১৯৭৪ সালে এখানে পুরাতাত্ত্বিক খনন কার্য চালিয়ে বহু প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার হয়। এর পরে আর কিছু হয়নি, এই ঐতিহাসিক স্তুপ এখন অবহেলার শিকার।চতুর্দিকে ৭০০/৮০০ বছরের প্রাচীন , পূর্বজদের দৈনন্দিন ব্যবর্হিত সামগ্রী মাটির হাঁড়ি- কড়াই - বাসনপত্র- থালা-বাটি- গ্লাস, পায়ের নিচে আমাদেরই পায়ের চাপে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। বুকের ভিতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো, আজ আমরা নির্দ্বিধায় পূর্বজদের গড়া সভ্যতা কে পদদলিত করছি, মহাকালের রথের ঘোড়া কিন্তু একদিন এর প্রতিশোধ নেবেই নেবে।


তথ্য সূত্র:- 
১)মঙ্গলকাব্যে লোকজীবন ও লোক ধর্মভাবনা। অমিতাভ গোস্বামী।
২)মনসামঙ্গলের ভৌগোলিক পটভূমি, অনির্বান ভট্টাচার্য। ঋদ্ধি , আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা: ১, বর্ষ ১৩।।সংখ্যা ২১।। সেপ্টেম্বর, ২০১৭।
৩)মনসামঙ্গল উইকিপিডিয়া।
৪পদ্মাপুরান বা মনসামঙ্গল, কবিবর ‍‍‍৺বিজয় গুপ্ত প্রণীত, চতুর্থ সংস্করণ।শুধাংশু সাহিত্য মন্দির।
৫)নীহাররঞ্জন রায়- বাংলার ইতিহাস, আদি পর্ব( প্রথম প্রকাশন ১৯৭২, পুনর্মুদ্রণ ২০০৫, পৃষ্টা ৭৫, দেজ পাবলিশিং, ১৩, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা)
৬)বাংলা মঙ্গলকাব্যে লৌকিক উপাদান। ডা: ইন্দুভূষণ মন্ডল।
৭)সাপ নিয়ে কিংবদন্তি। অবণীভূষণ ঘোষ, অমিয়কুমার হাটি, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। কথাশিল্প, ১৯, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা।

Saturday, June 27, 2020

বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।

বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।
বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।ছবি-লেখক
চলুন আমার সঙ্গে আমার দেশ, আমার বাংলা, আমার ভারতবর্ষের দর্শনে,  ধামসা মাদলের খোঁজে- বাঁকুড়া জেলার  সাঁওতাল আদিবাসী অধ্যুষিত বাঁশকানালি গ্রামে। এখানে প্রতি বছর  বুদ্ধ পূর্ণিমার পরের পূর্ণিমায়  অনুষ্ঠিত হয় "বাহা- মা: মড়ে অনুষ্ঠান"।

সাঁওতাল উপজাতিদের নিয়ে কিছু বলা যাক।এরা বিশ্বাস করে এদেরই পূর্বপুরুষ ছিলেন একলব্য, যাঁকে অত্যন্ত অন্যায় ভাবে দ্রোনাচার্য তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুল গুরুদক্ষিণা হিসাবে চেয়েছিলেন। তাই জানেন কিনা জানিনা, আজকেও সাঁওতালরা তীর ছোড়ার সময় বুড়ো আঙুল ব্যবহার করে না। অবশ্য এরকম অন্যায় কাজের উদাহরণ তো আমাদের দেশে ভুরি ভুরি ঘটেছে- শত শত একলব্য, শম্বুকদের কথা আর কেই বা মনে রাখে !






বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।

সাঁওতালরা - কিসকু, মুর্মু, হাঁসদা, সরেন,
টুডু,মানডি, বাস্কে , বেদিয়া, বেসরা, পাউরিয়া, চোঁঁড়ে, হেমব্রম এই বারোটি পারিস বা গোষ্ঠী বা গোত্রে বিভক্ত। আরেকটা কথা- সাঁওতালরা প্রকৃতির উপাসক, মূর্তি পুজো করেনা। 

সাঁওতাল নামে এঁদের পরিচিতি পরে হয়েছে, আদিতে একদা ১২ টি বিভিন্ন জাতি- কোল, ভীল, মুন্ডা, ওঁরাও, কুর্মি, সাঁওতাল, বিদিয়া, বিড়হড়, কোড়া, গন্ড, দেশওয়ালী এবং মাহালি- এঁদের নিয়েই ছিল বৃহত্তর খেরওয়াল গোষ্ঠী। পরে এরা ভাগ হয়ে যায় ভিন্ন ভিন্ন জাতি হিসাবে। 

সাঁওতাল উপজাতিদের বাহা- মা: মড়ে উৎসবে মেতে ওঠার আগে এবং কিছু বলার আগে রাঢ় বাংলা এবং বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কিছু দরকার আছে বলে মনে হয়।
 আমরা বাঙালিরা গর্বিত আর্য জাতি, আমাদের নিয়ে কবি লেখেন-" মোক্ষ মুলার বলেছে আর্য,/ সেই থেকে মোরা ছেড়েছি কার্য।"

দেখে নিই আমরা কতটা আর্য, আর যাঁদের আমরা অনার্য বলছি, তাঁদের নিয়েও কিছু আলোচনা করছি। আর্য জাতি তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে যখন ভারতে, ভালো করে বললে উত্তর ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত আছে, বাংলাদেশে তখন আদিতম দ্রাবিড় গোষ্ঠী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিম জনজাতি গোষ্ঠী বা প্রটো অস্ট্রোলয়েড গোষ্ঠীর লোকেদেরই বসবাস। এরা ছিল অতি উন্নত জাতি, এরা অস্ট্রিক ভাষায় কথা বলত।

পরবর্তী কালে  অবৈদিক আর্য যেমন আলপিও, দিনারিও ইত্যাদি জন গোষ্টিও বাংলার মাটিকে বাসভূমি হিসাবে গ্রহণ করে থিতু হয়ে বসে। এই দ্রাবিড় এবং মুখ্যত অবৈদিক আর্য আলেপিও , দিনারিও গোষ্ঠীর লোকেদের সঙ্গে অস্ট্রিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারক গোষ্ঠীর মিলনের ফলেই আজকের বাংলাদেশের বাঙালি গোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক উৎপত্তি। অর্থাৎ বাঙালি হচ্ছে মিশ্র শংকর জাতি।বৈদিক আর্যদের বঙ্গ বিজয় এবং বৈদিক সংস্কৃতির আবির্ভাব এর অনেক পরের ঘটনা।বঙ্গ সংস্কৃতিতে অনার্য প্রভাব নিয়ে বলা যায় যে নৃতাত্ত্বিক ভাবে বাঙালি যে উন্নত জাতি তার কারণ হচ্ছে, বাঙালির রক্তে আছে তিনটি সভ্যতার - প্রোট অস্ট্রোলয়েড, দ্রাবিড় এবং মিশ্র আর্যভাষী- সভ্যতার মিশ্রণ। তাই বঙ্গ সংস্কৃতি বলতে কেবল ব্রাহ্মণ‍্য সংস্কৃতি আদৌ বোঝায় না। এর পরতে পরতে মিশে আছে আদিম জনজাতি, অবৈদিক সভ্যতার প্রভাব। 

তাই বিদেশি পন্ডিতেরা যখন বলেন বহিরাগত আর্যদের দ্বারা ভারতবর্ষের সু সভ্যতার প্রচলন ঘটেছে , তখন বোঝা যায়,এনাদের চেতনায় ছড়িয়ে আছে, ভারতীয়দের সম্মন্ধে এক তুচ্ছতাচ্ছিল্য মনোভাব। বাইরের সভ্যতার সংস্পর্শে এসেই ভারতীয়রা সভ্য হয়েছে। এর থেকে মিথ্যা মিথ আর হয়না- অতি উন্নত সিন্ধু সভ্যতার প্রচলন কারা করেছিল ? কোথায় ছিল তখন সভ্য আর্যরা ?
সুর- অসুর, আর্য-অনার্য  ইত্যাদি শব্দগুলি নিয়ে চমৎকার নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন  সুহৃদকুমার বাবু তাঁর আর্য রহস্য বইয়ে। তাঁর লেখা কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি-" আমরা সকলেই জানি যে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর কিছুই নয়, খুব কম হলেও চারটি মৌলিক ভাষা-গোষ্ঠীর মানুষের সমবায়ে গঠিত এক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। কাল অনুসারে তারা হল অস্ট্র-এশিয়াটিক কোল গোষ্ঠী
, দ্রাবিড়, ইন্দো- যুরোপীয় বেদিয়া শ্রেণী ও ভোটচিনীয়।। ম্যাক্স মুলরের সময় থেকে বিনা কারণে যাযাবর জাতিটি সহসা আর্য নামে অভিহিত হতে লাগল।ঐ যাযাবর জাতিটি ছাড়া অপর সকলেই ছিল স্থায়ী বসবাসকারী কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠী। আর যাযাবর বেদিয়ারা স্থায়ী বসবাসকারী মানুষের কাছে আসত ঔষধ বিক্রয় করতে, তুকতাক করতে আর সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য দুর্বোধ্য সব জাদুমন্ত্রে ভগবানকে ডাকতে।....."


 বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া । মোড়ল মশায়ের বাড়ীতে।

রাত প্রায় আটটা, আমরা এসে পৌঁছেছি , বাঁকুড়া জেলার সাঁওতাল আদিবাসী অধ্যুষিত বাঁশকানালি গ্রামে । এখানে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বাহা- মা: মড়ে অনুষ্ঠান , প্রথম দিনের অনুষ্ঠান হবে ওঁদের পুরোহিত বা নাইকির বাড়ীতে। সিমলাপাল থেকে এই গ্রামের দূরত্ব ১০ কিমি র মতন।
আমরা  উঠেছি,  শ্রী মহেন্দ্রনাথ সরেন এই বাঁশকানালি গ্রামের মোড়লের বাড়িতে। এনার ছোটভাই ডাক্তার এবং আমার স্ত্রীর সহকর্মী। ডাক্তার ও সপরিবারে এসেছে। একগাড়ি পল্টন এসে তিনদিনের জন্য খুঁটি গেড়ে বসলাম, মোড়লের বাড়িতে। কিন্তু মোড়ল ই তো এই আনন্দ উৎসবের মুখ্য হোতা। আমাদের সামলাবে কে ? কুছ পরোয়া নেই, মোড়ল মশাইয়ের বৌদি, আমাদের সবার বড় বৌদি, সদা হাস্যময়ী , সাক্ষাৎ মা অন্নপূর্ণা- মকরি সরেন বৌদি স্বেচ্ছায় সব ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। তার আগে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা এসে সোনা রঙের কাঁসার ঘটি থেকে জল ঢেলে, কাপড় দিয়ে পা মুছিয়ে দিয়ে, একে একে সবাই ভূমিষ্ট হয়ে প্রনাম করল। কিচ্ছু করার নেই, এই রীতিই এখানকার দস্তুর। সরল আদিবাসীদের এই অকৃত্রিম ভালোবাসায় চোখ ভিজে উঠবে। নব্য বঙ্গজদের কাছে, এসব হয়ত ফালতু মনে হবে। বাচ্চা মেয়ে বলতে যাঁদের বুঝিয়েছি, সেই শান্তি হেমব্রম, শ্যামলী সরেন ইত্যাদি ভাইজি, ভাগ্নীরা সবাই কমপক্ষে এম এ পাস এবং স্কুল শিক্ষিকা।

বিশাল উঠোন, পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। সারি সারি খাটিয়া পাতা। এতেই চলেছে, গান, আড্ডা, নাচের মহড়া। তালবাদ্যের রণ সংগীতে, এর মধ্যেই রক্ত গরম হতে শুরু করেছে। ঝকঝকে নিকানো উঠোনে, এই বাড়ির মেয়েদের হাতে বোনা আসনে বসে, বড় বৌদির হাতের অমৃত সম রান্নার স্বাদ, সারা জীবনের মণিকোঠায় তোলা থাকলো।

মোড়ল মশাইকে ঘিরে গল্প শুনছি। ঠিক গল্প নয়, অজানা সংস্কৃতির গল্প। এই গল্প আমাদের শোনানো হয়না। যে অস্ট্রিক সভ্যতা- ভারতীয় সভ্যতার অন্যতম ভিত্তি, তাঁদের কথা তাঁদের উত্তরসূরিদের মুখ থেকেই শোনা যাক।
মহেন্দ্রনাথ সরেন হচ্ছেন মোড়ল বা মাঝি হাড়াম। ইনি হচ্ছেন এই গ্রাম সমাজের মুখ্য কর্তা। এ ছাড়াও আরো চারজন কর্তা আছেন। পারানিক বা পরামানিক , পরামানিকের সহকারী- জগ পারানিক,  গোড়ায়েৎ বা কাইলি( উৎসবের বার্তাবাহক), জগ মাঝি( মরাল পুলিশ বলা যায়)।
এই যে বাহা- মা মড়ে অনুষ্ঠানে আমরা এসেছি, এর নির্ঘন্ট কিন্তু তৈরি করেছেন- সমাজ কর্তারা মিলে ।  একটি (জেনারেল বডি মিটিং) আলোচনা সভা বা " কুলহি দুড়ুপ:" এ বসে এই নির্ঘন্ট তৈরি হয়েছিল।

মা: অর্থ জাহেরআয়ু মা, যিনি আবার সৃষ্টিকর্তা মারাং বুরুর স্ত্রী। আর মড়ে অর্থ পাঁচ। বৃহত্তর অর্থে পাঁচ ঠাকুরের কাছে মানসিকের কমপক্ষে পাঁচটি পাঁঠা/ছাগল বলি। বসন্ত উৎসবের বা ফুলের উৎসবের অনুষ্ঠান বাহা পরব তো চৈত্র মাসে হয়ে গেছে। কিন্তু বংগা দেবতার থানে যারা মানসিকের ব্রত করেছিল, সেই মানসিকের ব্রত রাখা মানুষ গুলির জন্য, বুদ্ধ পূর্ণিমার পরের পূর্ণিমায় এখানে পালন করা হয় মা: মড়ে উৎসব। মারাং বুরু, জাহেরআয়ু, মড়ে-কো-তুড়েইক, সেন্দ্রা বঙ্গা, হারাং বঙ্গা- এই পাঁচটি মুখ্য দেব-দেবীর থানে চারটি পাঁঠা ও একটি ছাগি বলি হচ্ছে পুজোর অঙ্গ। জাহের আয়ু দেবীর নামে ছাগি বলি হয়।

এক সময়ে মা- মড়ে পুজোর সূচনায় বা কুটাম ডাংরিতে গো দান করা হত। এখন মূল্য ধরে দেওয়া হয়।
এই মুখ্য দেবতাদের থানেই আছেন রস্কে বঙ্গা। ইনি সাঁওতাল সমাজের রসে বসে থাকা আনন্দের ঠাকুর বলতে পারি।
বাঁয়ে ধামসা, ডাইনে রেগরা বাদকের দল।
এই বলি উৎসব কিন্তু হবে দ্বিতীয় দিনে, অর্থাৎ আগামীকাল, যাকে বলা হয় সারদি-র দিনে।
১ ম দিনের পু জো শুরু হয়েছে, ছবি লেখক।
রাত নয়টায় ঢুকলাম- প্রধান পুরোহিত বা নাইকির বাড়ির উঠানে। লোকে লোকারণ্য। দুই দিকে বাজনাদারেরা বসে গ্যাছে তাঁদের বাজনার যন্ত্র নিয়ে।আরেকদিকে মেয়েরা বসে । আধো অন্ধকারে এক আধি দৈবিক, আধি  ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ধামসা, মাদল, রেগড়া, সাঁকোয়া কত রকম বাদ্যযন্ত্র , বিশাল জায়গাজুড়ে কি অসাধারণ একটি পরিবেশ তৈরি করেছে, লিখে বোঝান যাবেনা। তিনদিনের উৎসবের আজকে অনুষ্ঠানের প্রথম দিন, ওঁরা বলেন 
ওঁম ।
বাঁ দিকে মুখ্য পুরোহিত বা নাইকি- বীরেন সরেনের ঘর। মূল ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছে, নাইকির উঠানের তুলসী মঞ্চ ঘিরে। নাইকির সহকারী একটি কম বয়সী ছেলে- যাকে ডাকা হয় " কুডম নাইকি" বলে।
একদিকে পুজো আর্চা চলছে, মাঝে মধ্যে ধুনোর ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। সমস্ত ইলেকট্রিক আলো নিভিয়ে দিয়ে একটিমাত্র হ্যাজাকের আলোতে এতবড় অনুষ্ঠান চলছে।
রাত ১ টা বাজে, অনুষ্ঠান চলছে।

ধামসা, মাদল, খোল এগুলি সবই হচ্ছে আনন্ধ শ্রেণীর বাদ্যযন্ত্র, অর্থাৎ প্রতিটি বাদ্যযন্ত্র চামড়ার আচ্ছাধন দিয়ে তৈরি। 
ধামসা বা নাগারা আদিতে রণসঙ্গীত হিসাবে যুদ্ধের সময় বাজানো হত। তবে বর্তমানে মানভূম এবং ছোটনাগপুর জেলার বিভিন্ন নৃত্যগীত এবং শোভাযাত্রায় ব্যাপকভাবে এটি বাজানো হয়। ধামসা বা নাগারার অন্য নামগুলো হচ্ছে টিকারা, দামামা, ঢক্কা, ডঙ্কা ইত্যাদি।

আগে শিশুকাঠ দিয়ে ধামসার খোল তৈরি হতো। তবে বর্তমানে লোহার চাড়ির মুখে গরু বা মহিষের চামড়া দিয়ে এর ছাউনী তৈরি হয়। ছাউনী তৈরিতে গাব(গাব ফলের আঠা) বা খিরণ লাগানো হয় না।
ধামসা দুটি মোটা কাঠির সাহায্যে বাজানো হয়। ধামসা কিন্তু ছোট ও বড় - দুটি মাপের হয়। বোলের শব্দ শুনে দ্রিমি দ্রিমি, দ্রিম দ্রিম ধ্বনি বলে মনে হয়। বাঁশ পাহাড়ির অনুষ্ঠানে দুই সাইজের ধামসা দেখতে পেলাম।

প্রায় এরকমই আওয়াজ বেরোচ্ছে আরেকটি বিশাল বাদ্যযন্ত্র থেকে। এটির নাম রেগড়া। এটি কিন্তু সমান দৈর্ঘ্যের দুটি কাঠি দিয়ে বাজানো হচ্ছে।

বিশাল আকারের মহিষের শিঙে প্রস্তুত আরেকটি বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে সাঁকোয়া। শিঙের মধ্যে একটি ফুটো থাকে। এই ফুটোতেই ফুঁ দিয়ে সুর তুলছে। মধ্যে মধ্যে শিল্পীকে যন্ত্রের মধ্যে জল ঢেলে পরিষ্কার করতে দেখলাম। সাঁকোয়া বহু প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র। একজন শিল্পীর সঙ্গে আলাপ হল- উনার নাম লখিন্দর মুর্মু। উনি এই যন্ত্র বাজাতে শিখেছেন উনার গুরু মহেন্দ্রনাথ সরেনের কাছে।

মহিষের শিঙে প্রস্তুত আরেকটি বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে সাঁকোয়া। 

এবার আসি মাদলে।
মাদল দেখতে অনেকটা সিলিনড্রিকাল , এরকমই দেখতে একটু ছোট বাদ্যযন্ত্র কে লাগা বলে। এটি তৈরিতে পোড়ামাটির খোল লাগে। এখানেও খোলা মুখ দুটিতে গরু/মোষের চামড়ার ছাউনী লাগানো হয়। ছাউনির মাঝখানে গাব ফলের আঠা বা খিরণ লাগিয়ে চামড়া শক্ত ও টেকসই করা হয়। এছাড়া খোলের উপর তবলার মতন সরু সরু চামড়ার ফিতের বাঁধি লাগানো হয়। নাচ গানের সময় বেশির ভাগ জায়গায়, দুটি মাদল এবং একটি লাগা ব্যবহার করা হয়। তাই দুটি মাদল এবং একটি লাগা নিয়ে মাদলের একটি সেট হয়। আদিবাসী নাচে গানে, ঝুমুর গান এবং নাচে, মাদল বাজবেই।

খোলও একটি পোড়ামাটির বাদ্যযন্ত্র। মৃৎ বা মাটির তৈরি বলে এর আরেকটি নাম মৃদঙ্গ। খোলের আকার অনেকটা কলার মোচার আকৃতির। দুই দিকের খোলা মুখ দুটিতে চামড়ার আচ্ছাদন বা ছাউনী লাগানো হয়। ডানদিকের মুখটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র , বামদিকের মুখের চেয়ে। এখানেও চামড়ার মাঝখানে গাব বা খিরণ লাগান হয়।বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে, কীর্তন গানের সঙ্গে খোলের বহুল ব্যবহার করা হয়, তাই একে কীর্তন খোল ও বলে।

রাত একটা বেজে গেছে, , নাচ- গান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছেই। শুনলাম চলবে রাত তিনটে অবধি। অনেকের উপরে দেখলাম দেবতার  ভর হয়েছে। তাঁদের ব্যাবহার ও চলন বলন, কেমন অদ্ভুতভাবে বদলে যাচ্ছে।

 ফিরে এলাম ঘরে। সত্যিকারের রাম রাজত্ব দেখতে হলে এই সাঁওতাল গ্রামগুলিতে আসতে হবে। এত লোক রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে, বাইরে থেকে এত  লোক এসেছে, বাড়ির সামনে থেকে পিছন অবধি সব দরজা/জানলা খোলা। আমি তো চাঁদের আলোয় শুয়ে পড়লাম, উঠানের খাটিয়াতে। শেষ রাতে শুনি মাথার উপরে মোরগের ডাক। তখনও ঠিকমতন আলো ফোটেনি, কিছু বুঝতে না পেরে, মাথার উপরের আমগাছে ,টর্চের আলো ফেলে চক্ষুস্থির। গাছের উপরে কাতারে কাতারে মুরগি চড়ে বসেছে। এমন অদ্ভুত দৃশ্য, জীবনে প্রথম দেখলাম।

আমগাছে মুরগি, বাপের জন্মে দেখিনি।
পরের দিন সকালে এই মুরগি রহস্য উদ্ধার হল। এখানে প্রত্যেকের ঘরেই লড়াকু কাশিপুর মোরগ পোষা হয়। এই মোরগ পোষা হলেও, মোটামুটিভাবে উড়তে পারে। চোর ডাকাত না থাক, মুরগির খোঁজে শিয়াল বা হুরাল প্রায় গ্রামে হানা দেয়। তাই ডারউইন সাহেবের মতকে মেনে নিয়ে এরাও শিয়ালকে কাঁচকলা দেখিয়ে, রাতের বেলা গাছের মগডালে চড়ে বসে থাকে- survival for the fittest . তবে ওদের জন্য সেকেন্ড লাইন অফ ডিফেন্স, নিঃশব্দে একটু দূরে শুয়ে থাকে। কি তাগড়াই দেশি কুকুর। এগুলোকে শিকারের জন্য সঙ্গে নেওয়া হত একসময় বলে, এদের জিনগত পরিবর্তন সাংঘাতিক হয়েছে। পারত পক্ষে গলা দিয়ে আওয়াজ করেনা। কিন্তু শেষ রাতে কালুর ডাকে, রক্ত জল হয়ে গেছিল, যেন হাউন্ড অফ বাসকারভিলের ডাক। আবার জানলাম যে, শিকারে গেলে শিঙ্গা ফোঁঁকার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি এই দেশি কুকুরগুলি একসঙ্গে ডাকতে থাকে।
কাশীপুর মোরগ ব্রিড করা হচ্ছে,


বাহা- মা: মড়ে উৎসবের দ্বিতীয় দিন। বাঁশকানালি, বাঁকুড়া।

আগেই লিখেছি, বাহা- মা: মড়ে উৎসবের দ্বিতীয় দিনটিকে  বলা হয় সারদি।
আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।

বাগানে এত বড় বড় এঁচোর ঝুলছে।

মাছ ধরতে নদীতে যাওয়া।
সকালে উঠে প্রথমে গেলাম সবজি তুলতে, আজ্ঞে হাঁ- সবজি কিনতে নয়, খেত থেকে সবজি তুলতে।
খেত থেকে তোলা সবজি ।
মোড়ল মশাইয়ের বিশাল খেত, তবে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। আর গাছের আম পাড়া হল। দুটি গাছে ১০০ র মতন এচোড় ধরেছে, কিন্তু পাড়তে পারলাম না, এত বিশাল সাইজ, নিয়ে যাব কি করে।এরপর ব্রেকফাস্ট খেতে বসলাম ,মেঝের উপরে হাতে বোনা আসনে, শাল পাতার থালা-বাটিতে। এরা পরিবেশ নিয়ে শুকনো ভাষণ দেয়না। আপনি আচরি ধর্ম পালন করে দেখায়। তাই এত শিক্ষিত ও আধুনিক হয়েও, জঙ্গলে গিয়ে শালপাতা ও নিমের পাতা নিয়ে আসে। এই থালা,বাটি  ঘরে তৈরি হয়েছে, শালের পাতা ও নিম গাছের শুকনো কাঠি বা চাবেচ দিয়ে। থালা বাটি তৈরি করার জন্য রীতিমতো একটি ট্রেনিং ক্লাস নিল ভাগ্নি মিনতি মুর্মু।

শালপাতার থালা বাটি তৈরির ট্রেনিং।
আর মোড়ল মশাইয়ের কাছে শিখলাম, শাল পাতার বিড়ি বা চুটটা বানাবার কৌশল। রোমে গিয়ে রোমান না হলে কি চলে !
শালপাতার চুটা।

রীতিমত ভীতিপ্রদ,  বিশাল চেহারার একটি চ্যাম্পিয়ন কাশিপুর মোরগ, উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টিয়া পাখির মতন ঠোঁট, ময়ূরের মতন লেজ মাটিতে লুটিয়ে চলেছে, উচ্চতায় কম করে ফুট দুয়েক, বয়স শুনলাম একবছর মাত্র। মোরগ লড়াইয়ে ওকে দেখেই, অপনেন্ট পগারপার ।

উঠোনের খাটিয়াতে শুয়ে শুয়ে বাড়ির সবার কাছ থেকে, বঙ্গ সংস্কৃতির এক অজানা পর্বের গল্প শুনছি। আর বড় বৌদি সমানে টুকটাক মুখ চালাবার সামগ্রী সাপ্লাই করে চলেছেন।
 বহিরাগতরা হচ্ছে  দিকু, খালি সাঁওতাল গোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদের পরিচয় দেয় হড়(মানুষ) বলে। এঁদের আদি পুরুষ হচ্ছে পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুরহি। জাতিতে খেরওয়াল।
ওঁদের গানেই আছে-
 " এ বাবা পিলচু হারাম, এ আয়ো পিলচু বুরহি,
জানাম বাবা বেন জানাম কেৎলিঞ, জৌত বাবা বারেন এমাৎলিঞ ।
জৌতি হো জৌতি গে জৌতি খেরওয়াল।"
অর্থাৎ পিলচু বুড়ো ও পিলচু বুড়ি, আমাদের তো জন্ম দিলে। কিন্তু আমাদের জাতি কি ? জাতি হে জাতিই জাতি, খেরওয়াল জাতি তোমরা।


সাঁওতালদের আদি সমাজ হচ্ছে- বিন্দির  হড় সমাজ। পরে আদি সমাজ থেকে বেরিয়ে গিয়ে সাফা  হড় সমাজ ও ইসৈঁঁয়  হড় সমাজ নামে আরো দুটি সমাজ গড়ে ওঠে।
সাঁওতাল সমাজে কিন্তু স্বগোত্রে বিবাহ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এছাড়াও শুনলাম 
বেসরার সঙ্গে টুডু এবং মাণ্ডির সঙ্গে কিস্কু গোত্রের বিবাহ হয়না।
বিন্দি সমাজে ডালার মধ্যে আর সাফা সমাজে বিয়ের মণ্ডপে (মারওয়া) বিয়ে হয়। বিয়েকে বলা হয় বাপলা। ৪/৫ দিন ধরে বিয়ের পরব চলে। এঁদের সমাজে সাত প্রকার নামের বিবাহের প্রচলিত আছে।
১) ঘটকের(রাইবার হারাম)  সম্বন্ধ করা বিয়ে বা দুয়ার বাপলা, এই বিবাহই সবচেয়ে বেশি হয় ।২) ইপতুৎ অর বাপলা,। ৩)শাঁখা বাপলা।, ৪) ঘরদি জায়ায় বাপলা ।, ৫) টুনকি দিপিল বাপলা,(পাত্রী পক্ষ যদি বিয়ে দিতে অসমর্থ হয়, তখন ছেলের বাড়িতে বিয়ে হয়)।, ৬) অর বাপলা।, ৭)আপাঙ্গির বাপলা (অপহরণ করে বিয়ে) ।
দুয়ার বাপলা বিয়ের প্রথমে হয় পাকা দেখা( ঞেপেল), এটি সাধারণত মেয়ের বাড়িতেই হয়, তবে ছেলের বাড়িতেও হতে পারে।এর পরে হয় সামান্য কনেপন বা "গনং এপেম " দেওয়া। সঙ্গে তত্ব হিসাবে মেয়ের মা, মাসি ও পিসীদের জন্য শাড়ি দেওয়া হয় । তবে অনেক সময় গাভী সম্প্রদানের প্রথাও প্রচলিত ছিল , জানতে পারলাম যে মোড়লের ছোটভাই ডাঃ রাজেন্দ্রনাথ সরেন, তাঁর বিয়েতে দুধেল গাই দিয়েছিলেন। ওঁর স্ত্রী শ্রাবনীর মুখে এই কথা শুনে সমবেত স্রোতাদের মধ্যে  হাসির রোল পরে গেল।
এরপরে মেয়ের বাড়ির মত নিয়ে একদিন ঘটক কনে ও তার গুটিকয়েক বান্ধবীকে , বরের বাড়িতে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে যান। এই অনুষ্ঠানকে বলে কিচরিচ বান্দি। শেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে বালায়া জহার। মেয়ের বাড়ির লোকেরা ছেলের বাড়িতে গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচিত হন। বরকে নতুন ধুতি পরিয়ে ভোজের( জমঞু) অনুষ্ঠান হয়। 
শেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে বিবাহ মণ্ডপ বা " মারোয়া" তৈরি করে দুই বাড়িতেই তেল-হলুদ মাখান বা " তেলাই দান" পর্ব। আর রয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠানে কুলোর মধ্যে ধান-দূর্বা, আতপ চাল, মিষ্টি ইত্যাদি রেখে বরণ করা । কুলোকে সাঁওতালরা মনে করে লক্ষ্মীর চিন্হ, এবং ধান - দূর্বা দিয়ে বরণ করলে ধরা হয়, নবদম্পতি দীর্ঘায়ু ও সুখী হবে। যে কোন আদিবাসী বিয়ের মুখ্য অনুষ্ঠান হচ্ছে সিঁদুর দান। তাহলে মোড়ল মশাইয়ের কাছ থেকে কি জানলাম ? জানলাম যে আমাদের হিন্দু বিয়ের লোকাচার তেল-সিঁদুর মাখান, ধান- দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করা এবং সর্বোপরি সিঁদুর দান- এগুলি সবই আদতে অস্ট্রিক সভ্যতার দান । কৃষিকার্জ যেহেতু অস্ট্রিক সভ্যতার দান, তাই চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত কত অস্ট্রিক শব্দ যে আমরা ওঁদের কাছ থেকে পেয়েছি, আমরা নিজেই তা জানিনা, যেমন- লাঙ্গল, ধান, বেগুন, পান, লাউ, নারকেল,হলুদ, সুপারি, কাপাস, পাট, বাছুর, দা, করাত, ঢেঁকি, মুড়ি- এ শব্দ রাশি শেষ হবার নয়। এমনকি বঙ্গ , গঙ্গা ইত্যাদি নামগুলিও আদতে অস্ট্রিক শব্দ।

আরো দুটি বিয়ের কথা জানলাম। বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ের বিয়েকে বলে সাঙ্গা। আর একবাড়ির ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে অন্য বাড়ির মেয়ে ও ছেলের পালটি বিয়ে হচ্ছে " গোলাত" বিয়ে। 
এরপর যখন কোন সন্তান জন্মায় তখন সারা পরিবার শুধু নয়, পুরো গ্রামে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়, কারণ এঁদের শিশু জন্মহার বেশ কম। বাচ্চার মাথার বালিশের নীচে অপদেবতার প্রভাব কাটাতে একটি লোহার টুকরো রাখা হয়। সুবিধা মতন ১/২/৩/৫/৭ দিন পরে ঘরদোর গোবর দিয়ে তকতকে করে নিকানো হয়। বাচ্চাটার মস্তক মুন্ডন ও নখ কাটার জন্য আসে নাপিত। জিওণগাডা বলে একটি লোকাচার অনুষ্ঠান হয়, সকালে হয় নিমপাতা সহ খিচুড়ি রেঁধে খাওয়া। পরে হয় মুড়ি সহযোগে হাঁড়িয়া পান। প্রথম সন্তান ছেলে হলে ঠাকুরদা ও মেয়ে হলে ঠাকুমার নামে নামকরণ করা হয়। বেশিরভাগ বাড়িতে পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে ৬ মাসে এবং কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে ৭ মাসে অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠিত হয়।
আর সাঁওতালদের মধ্যে কেউ মারা গেলে দাহকার্য এবং কবর দেওয়া প্রচলিত আছে। গর্ভবতী নারী এবং শিশু মারা গেলে কবর দেওয়া হয়, অন্যথায় দাহ করা হয়। সাধারণত বড় ছেলে মুখাগ্নি করেন, অভাবে মৃতের নিকটজন কেউ। অস্থিভস্ম আর কাদা মিশিয়ে একটি তাল বানিয়ে মাটির হাঁড়িতে পুড়ে বাড়ির চালে বা মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। পাঁচদিন পরে হয় " তেলনাহান" অনুষ্ঠান। অস্থি কলস সাধারণত কোন নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।বাড়ির সবাই চুল, নখ, দাড়ি কেটে, স্নান করেন।
এরপর ১৫ দিনের মাথায় হবে শ্রাদ্ধ বা " ভাড়াঁঁন" অনুষ্ঠান। গোবর লেপা উঠোনে একটি সজনে গাছের ডাল পুঁতে অনুষ্ঠান স্থল তৈরি করা হয়। মারাংবুরু এবং পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে মুরগি, ছাগী, শুকরী শেষে পায়রা বলি হয়। আর পুজোর প্রসাদের সঙ্গে থাকে হাঁড়িয়া।

সাঁওতাল সমাজে অসংখ্য পরব। অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন, ফাল্গুন মাসে দোল(বাহা)- ছাড়াও আরো অনেক পরব উদযাপিত হয়। যেমন আষাঢ় মাসে এরক- সিম, ভাদ্রমাসে গুণ্ডলী, অগ্রহায়ণ মাসে যন্থর পুজো, পৌষ সংক্রান্তিতে সংক্রান্ত পুজো, মাঘ মাসে- মাঘ সিম পুজো ইত্যাদি। আমার ছোটবেলায় আষাড়িয়া সিম পুজো তো চাষের জমিতে হতে দেখেছি।  আষাড় মাসে, জলভরা কাদা জমিতে ধান চারা রোপন করার আগে এই খেত পুজো হত।
শিলাবতী নদীতে ঘুরে আসা গেল।

কিছুক্ষণের জন্য শিলাবতী নদীতে ঘুরে আসা গেল, জল প্রায় নেই।
তারপর কানে ভেসে এল জাহেরআয়ু থান থেকে ধামসা- মাদলের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। ছুট-ছুট জাহেরআয়ুর থানে।
  ধামসা- মাদলের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ।

কাতারে কাতারে লোকে এসে ভীড় জমিয়েছে। একটি মাচা বানিয়ে তার উপরে শাল পাতা, শাল ফুল, মহুয়া ফুল, আমপাতা দিয়ে সাজান হয়েছে।
মাচার নীচে পুজোর আয়োজন।

মাচার নীচে পুজোর আয়োজন। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে মেয়েরা হাতে হাত ধরে নাচ করছে।


হাতে হাতে ধরি ধরি।
কি অসাধারণ সেই পরিবেশ। বলির পরে হল , মাংস ও খিচুড়ি ভোগ।কি দারুন লাগছিল এই সহজ সরল মানুষগুলির সঙ্গে বসে পঙক্তি ভোজ খেতে। এরপরে বলির উদ্বৃত্ত মাংস সবার বাড়িতে বিতরণ করা হল, জানিয়ে রাখি এই বাঁশকানালি গ্রামে সর্বমোট ৮৫ টি বাড়ি আছে। অনুষ্ঠানের সমস্ত খরচ প্রতিটি বাড়ির লোকেরা সমান ভাবে বহন করে। কোন রকম চাঁদা তোলা বা নেওয়া হয়না। তবে নাচ গানের আসরে আপনি টাকা দিলে, ওরা মাইকে অ্যনাউন্স করে আপনার দান গ্রহণ করবে।

নাচের আইটেম পাঞ্চি শাড়ি ও পাঞ্চি ধুতি। 

ফেরার সময় রাতের নাচের স্পেশ্যাল আইটেম পাঞ্চি শাড়ি ও পাঞ্চি ধুতি সঙ্গে মাথায় বাঁধার সুন্দর একটি কাপড় কেনা হল, সুদূর উড়িষ্যা থেকে আগত সাঁওতাল তাঁত কাপড় নির্মাতাদের কাছ থেকে, পুরো কাপড়গুলো কিন্তু ঘরের তাঁতে তৈরি। রাতে তো নাচতেই হবে, আদিবাসীদের নাচের ছন্দে পা মেলান- কত যুগের লালিত স্বপ্ন আজ পূরণ হতে চলেছে ।

এই জাহেরআয়ু থানেই আবার পূর্বপুরুষ দেবতা হারং বোঙ্গার থান অবস্থিত। সন্ধ্যা অবধি পুরোহিত বা নায়ক- বীরেন সরেন দেবতাদের থানেই ছিলেন। তারপর আবার ধামসা মাদল বাজিয়ে উনি ফিরে এলেন গ্রামের প্রতিটি ঘরে। সঙ্গে ঠাকুরের পুজোর জলপূর্ণ একটি ঘড়া এবং যুদ্ধ সাজে সজ্জিত ছেলেপুলের দল। আরো ছিলেন সেই সব ভক্তরা, যাঁদের উপরে দেবতার ভর হয়েছিল। এই উপলক্ষে, গ্রামের প্রতিটি ঘরের সামনে সোনা রঙের কাঁসার ঘড়ায় জল, কাঁসার বাটিতে তেল এবং একটি করে পিঁড়ি রাখা ছিল।
প্রতিটি বাড়ি থেকে দুটি মেয়ে বেরিয়ে, নায়েক এবং অন্যদেরও পা , জলে ধুইয়ে দিয়ে, তেল মাখিয়ে দেয় এবং সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। এভাবেই রাত বারোটা বেজে যায়।
বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।



বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।


বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।

সাঁওতালদের উৎসব আর নাচ গান হবেনা, তাও আবার হয় নাকি ! রাত ২ টো থেকে শুরু হল নাচ গানের এক অসাধারণ অনুষ্ঠান। সারা জীবনেও এই দিনগুলি ভোলা যাবেনা। এখন সকাল সাড়ে ছটা, অনুষ্ঠান এখনও চলছে।

 তৃতীয় দিন,অর্থাৎ আজকে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে জল খেলা, অর্থাৎ রং ছাড়া দোল খেলা ধরা যায়। চলবে শুনলাম বিকাল অবধি।  সময়ের অভাবে সেই অনুষ্ঠানে থাকা হল না। 

বাঁশপাহাড়ি গ্রামে গিয়ে এঁদের আচার আচরণের বিষয়ে আরো অনেক কিছু জানলাম।
সাঁওতালি ভাষায় দেবতাকে বংগা নামে ডাকা হয়। এঁদের জীবনেও বারো মাসে তের পার্বন।সহরাই, দাসাই,বাহা, বাহা- মা: মড়ে, সাকরাত, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এঁদের জীবনে বিভিন্ন উৎসব পালন জুড়ে আছে।

আদিবাসী সাঁওতাল সমাজের একটি অন্যতম পালা পার্বন ছিল শীষ বা বীজ বপনের পুজো। অনেকে এই উৎসবকে হারিয়ার সাম বা ধান বপনের উৎসব বলেন। জ্যৈষ্ঠ মাসে কৃষি জমিকে পুজো করে বীজ বপন করা হয়। সাঁওতালদের বিশ্বাস এতে কৃষি দেবী খুশি হয়ে ভালো ধান এবং ফসল দান করেন।
সাঁওতালদের দেবতা বঙ্গা আমরা অনেকেই জানি। সূর্যদেব বা সিং বোঙ্গার পুজোয় মুরগী বলির প্রচলন আছে । আবার মেরম বোঙ্গার পুজোয় ছাগ বলির প্রচলন। অর্থাৎ অস্ট্রিক সভ্যতার অন্যতম অবদান আজকের  হিন্দু ধর্মের বলি প্রথার প্রচলনের ।
সাঁওতাল সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ পরব  বাঁদনা বা সহরায় পরব। যদিও পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জায়গায় কালিপুজোর দিন থেকে পরবর্তী পূর্ণিমা অবধি সহরায় উৎসব পালন করা হয়, কিন্তু সাঁওতাল পরগনা, ছোট নাগপুর মালভূমির এক অংশে এবং রাঢ়বঙ্গের কিছু জায়গাতেও এটি পৌষ মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হয়ে পৌষ সংক্রান্তির আগে শেষ হয়।'ম৺ড়েসিঞ  ম৺ড়ে  ঞিদা' বা পাঁচ দিন পাঁচ রাতের অনুষ্ঠান হচ্ছে বাঁদনা পরব। নাচ গান আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে ভাই- বোন- জামাতা-বন্ধুদের মিলন উৎসব যেমন পালন করা হয়, তেমনি ঘর পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে গৃহপালিত পশুর যত্ন নেওয়া,সেগুলিকে চান করিয়ে, গরু মোষের শিঙে তেল সিঁদূর লাগিয়ে ধানের শীষের মুকুট পড়ানো হয়। গোয়াল ঘরে সারারাত ধরে প্রদীপ জ্বলে এবং বাঁশের বোনা নতুন কুলোয় ধান, দূর্বা, আতপ চাল, সিঁদুর এবং একটি জ্বলন্ত প্রদীপ দিয়ে গৃহপালিত পশুগুলির উদ্দেশে যে অনুষ্ঠান হয়, তাকে চুমাড়া বলে। এ ছাড়াও ছেলেরা গোয়াল ঘরের দরজার পাশে চাষের লাঙ্গল ও জোয়াল জলে ধুয়ে রাখে। মেয়েরা আলপনা দেয়। এরপরে হয় গোয়ালপুজো। বিবাহিত কন্যারা সপরিবারে এই কটা দিন পিতৃগৃহেই থাকে। যেন মা উমা আসেন বাপের বাড়িতে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি হয় গরু খেলানো উৎসব বা  খুঁন্ট( খুঁটা)। এমনি করে হাসি কান্নায় দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন কখন পেরিয়ে যায়। মেয়ে আবার চোখের জলে ফিরে চলে শ্বশুর বাড়িতে।

বাঁদনা পরব, করম পরব, ভাদু, টুসু, ছৌ, দিসম সেন্দ্রা, সহরায়, বাহা, বাহা-মা মড়ে পুরো আদি মানভূম জেলা এবং ছোটনাগপুর মালভূমিতে কত না উৎসব বা পরব। এর সঙ্গে আছে ঝুমুর গান ও নাচ।  
এসব নিয়েই সুরভিত হচ্ছে বঙ্গ সংস্কৃতি।

সাঁওতালদের একটি গান দিয়ে লেখা শেষ করছি-

"দেলায়া বিরিদপে দেলায়া তিঞূন পে,

জানাম দিশম লৌগিৎতে হো,

দেলায়া পায়ার:ক' তাবোন পে।"

ওঠো, জাগো, চলো জন্মভূমির জন্য এগিয়ে চলো।

এতো অনেকটা সেই বিবেকানন্দের অতি প্রিয় কঠোপনিষদের বাণীর মতন লাগছে না:- 

"উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।"

বাহা-মা: মড়ে অনুষ্ঠান , বাঁশকানালি গ্রাম, বাঁকুড়া।









তথ্যসূত্র:-
১) আবাদভূমি, তৃতীয় বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৬ - এপ্রিল ২০১৭।
২)সুহৃদকুমার ভৌমিক । আর্য্ রহস্য। মনফকিরা।
৩) আদিবাসী সমাজ ও পালপার্বন : ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে।লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। 
৪) বাংলার জনজাতি, প্রদ্যোত ঘোষ। পুস্তকবিপনি।
৫) বাংলার সংস্কৃতি: লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়। পালযুগ,গুপ্তযুগ, সেনযুগ, থেকে অদ্যাবধি। নারায়ণ সামাট। দেশ প্রকাশন।
৬)সাঁওতাল সমাজ সংস্কৃতি ও সংগ্রাম, শিবেন্দুশেখর মিশ্র। লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গ সরকার।